‘মীর কাসেমের ফাঁসি হলে তবেই কান্না থামবে’

একাত্তরের ঘাতক বাহিনী আলবদরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর হলে তবেই থামবে তার হাতে নির্যাতনে নিহত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমের স্বজনদের ৪৩ বছরের কান্না।

মঈনুল হক চৌধুরী মিন্টু চৌধুরী ও মিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 04:04 PM
Updated : 2 Nov 2014, 06:54 PM

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দীর্ঘ বেদনার কথা এবং অবশেষে সন্তুষ্টির কথা জানালেন শহীদ জসিমের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাজীব হুমায়ুন এবং মামাতো বোন হাসিনা খাতুন।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রোববার জনাকীর্ণ আদালতে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শুরার এই সদস্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে ও দুটি আংশিক প্রমাণিত হয়।

এর মধ্যে আংশিক প্রমাণিত দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে তাকে মোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

৪৩ বছরের অপেক্ষা শেষে রোববার ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে প্রত্যাশিত রায় পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন জসিমের অগ্রজ অধ্যাপক হুমায়ুন। এখন ফাঁসির রায় কখন কার্যকর হবে- তা নিয়ে প্রহর গুণছেন ৬৫ বছর বয়সী এই শিক্ষক।

রাজীব হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি একাত্তর সাল থেকে কাঁদছি আমার ছোট ভাইয়ের জন্যে। ফাঁসি হলে পরে আমার কান্নাটা কমবে। আমি আল্লাহর কাছে শোকর করলাম। এখন যেন ফাঁসি কার্যকর হয়, সেজন্যে সকালে প্রার্থনাও করলাম।”

মিরপুরের পূর্ব মনিপুরের নিজ বাসভবনে দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন রাজীব হুমায়ুন। বছর দুয়েক আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার বাম হাত অবশ হয়ে যায়। শারিরীক দুর্বলতা ও মানসিক চাপ নিয়ে রায়ের দিনে ছোট ভাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কাতর হয়ে পড়েন তিনি।

থেমে থেমে মোটা ফ্রেমের চশমায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, “জসিম আমার ছোট ভাই। চার বছরের ছোট ছিল। সে চট্টগ্রাম কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। গেরিলা যুদ্ধে জড়িত ছিল।”

কথা বলতে বলতে অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার ও স্বাধীনতার মন্ত্রে এগিয়ে চলা ভাইয়ের জন্য গর্ব ঝরতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই কণ্ঠ ধরে আসে তার।

“সন্দ্বীপ থেকে ধরে তাকে চট্টগ্রামে চালান দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে কিছু আলবদর তাকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে আটকে রাখে। সেখানে মীর কাসেম আলী অন্যান্য আলবদরদের সহায়তায় আমার ভাইকে হত্যা করে।”

সাত ভাই তিন বোনের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন তারা দুই ভাই ও এক বোন। বাবা-মায়ের শেষ সন্তান ছিলেন অনুজ জসিম উদ্দিন আহমেদ; ছয় নম্বর সন্তান ছিলেন রাজীব হুমায়ুন।

হুমায়ুন আবার ফিরে যান একাত্তরের দুঃসময়ে; তিনি বলেন, “গণমাধ্যম ও বিভিন্ন জনের কাছে খোঁজ পেতাম- খুব নির্যাতন করে মেরেছে ছোট ভাইকে। কীভাবে মারা গেছে- তা এক পত্রিকায় পড়লাম।

“সাক্ষ্য দিতে এসে একজন বলেছেন- মেরে তাকে কর্ণফুলী নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। নামাজ-জানাযা ছাড়া, দাফন-কাফন ছাড়া। মারার সময় মীর কাসেম আলী হাজির ছিল সেখানে।”

দীর্ঘ এই প্রতীক্ষায় পরিবারের অন্য সদস্যদের নানা জায়গা থেকে নানা তথ্য পেয়ে শুনতে যেমন তাদের খারাপ লাগত, তেমনি বিশ্বাসও করতে কষ্ট হতো।

“আমার বোন বলে- তাকে মেরে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে; সে আর কীভাবে ফিরে আসবে? আমার বোনের কাছে শুনেছি- ইলেকট্রিক শক দিয়ে তাকে কাসেম আলী মেরেছে বলে বোন শুনেছেন। ছাদ থেকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।”

তারপরও আশার ঘোরে থাকেন ভাষা বিশেষজ্ঞ ও নজরুল গবেষক রাজীব হুমায়ুন, “আমার এখনো মনে হয়, আল্লাহ হয়ত তাকে কোথাও বাঁচিয়ে রেখেছে। সে একদিন ফিরে আসতে পারে।”

ঘোর থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসেন তিনি। জসিমকে হত্যা করেছে আলবদররা এবং এজন্যে বদর কমান্ডারের ফাঁসির আদেশ হয়েছে- এই কথা উচ্চারণ করেন। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হলো?

মীর কাসেমের নির্যাতনে শহীদ জসিমের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক রাজীব হুমায়ুন

হুমায়ুন বলেন, “দেশে বিচার করতে চাইলে বিচার করা যায় কারো। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছে তাই সম্ভব হয়েছে। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার করতে চেয়েছেন, প্রমাণ হয়েছে- সদিচ্ছা থাকায় এটাও সম্ভব হয়েছে। এখন দেশে বিচারের ধারা ফিরে এসেছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ, এটা দরকার।”

বেঁচে থাকা দুই ভাই ও এক বোন ছোট ভাইয়ের হত্যার বিচারের প্রতীক্ষায় থাকলেও কেউ সাক্ষ্য দেননি ট্রাইব্যুনালে। যার সাক্ষ্যে মীর কাসেম আলীর প্রাণদণ্ড হলো, তিনি হলেন তাদের সত্তর বছর বয়সী মামাত বোন হাসিনা খাতুন।

‘কেন এমন হলো?’- এই প্রশ্নের জবাবে ষাটোর্ধ্ব রাজীব জানান, স্বাধীনতাবিরোধীদের হামলার আশঙ্কায় সাবধানে থাকতে পরিবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“আমরা মনে করি, এখনো মুক্তিযোদ্ধারা ইউনাইটেড নয়। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা, জামায়াত-আলবদর চক্র ইউনাইটেড। ফলে যে কোনো সময় তারা আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। সে ভয়ে আমরা সাক্ষ্য দিইনি।”

জসিমের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ায় তার প্রতি পরিবারের সদস্যদের কৃতজ্ঞতার কথা জানান তিনি।

১৯৫১ সালে সন্দ্বীপে জন্ম নেওয়া হুমায়ুন ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এবং ভাষাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সনও ছিলেন তিনি।

১৯৭৮ সাল থেকে উদীচীর প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ঢাবির সিনেট ও নীল দলেরও সদস্য ছিলেন।

ঘাতক মীর কাসেমের রায় দ্রুত কার্যকর দেখতে চান শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমের মামাতো বোন ও মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষী হাসিনা খাতুন।

মীর কাসেমের মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষী ও শহীদ জসিমের মামাতো বোন হাসিনা খাতুন

হাসিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আংশিক প্রমাণিত দুটি অভিযোগের একটিতে বিভক্ত রায় হয়েছে। এটা নিয়ে মনে একটা খটকা রয়ে যাচ্ছে। তবে চাই কোনোভাবেই যাতে রায় কার্যকরে দীর্ঘসূত্রতা না হয়।”

তিনি জানান, একাত্তরের নভেম্বরে ঈদুল ফিতরের পরদিন নগরীর বেপারি পাড়ায় তার বাসায় এসে পোলাও খেতে চেয়েছিলেন কিশোর যোদ্ধা জসিম। ফুফাতো ভাইয়ের আবদার মেটাতে তাকে পোলাও রান্না করে খাওয়ান তিনি। তার বাসা থেকে বের হওয়ার পর জসিমকে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী।

চার দশক আগের সেই ঘটনা তিনি ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন।

তিনি বলেন, “তখন জসিমের বয়স ছিল সতের-আঠারো। সে সন্দ্বীপে থাকত, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল জসিম।

‍“তখন সন্দ্বীপে কেরোসিন সংকট হওয়ায় চট্টগ্রাম শহরে এসেছিল জসিম। ঈদের পরদিন সে আমার বাসায় আসে। পোলাও খেতে চায়। দুপুরে পোলাও-মাংস খেয়ে সে বেরিয়ে যায়।”

ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনা একাদশ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়।

তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

হাসিনা খাতুন বলেন, “ডালিম হোটেলে আটকে রেখে জসিমকে অমানুষিক নির্যাতন করা হত। একদিন নির্যাতন করার পর জসিম একটু পানি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তাকে ‍পানি খেতে দেয়নি।

“সেখানে থাকা আরেক বন্দি অ্যাডভোকেট শফিউল আলম জমিয়ে রাখা হাত ধোয়া পানি জসিমকে খেতে দেয়। নির্যাতনের পর জসিম মারা গেলে কর্ণফুলী নদীতে নিয়ে লাশ ফেলে দেওয়া হয়।”

‍হাসিনা খাতুন বলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অ্যাডভোকেট শফিউল আলমসহ অন্যরা ডালিম হোটেল থেকে মুক্তি পান। শফিউল আলম আমাকে সেই ঘটনার কথা জানান।

“আমরা জসিমের লাশের কোনো হদিস পাইনি। তাকে কবরও দিতে পারিনি।”