চূড়ান্ত শুনানি শেষে দেড়মাস অপেক্ষার পর ঘোষণা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মো. কামারুজ্জামানের আপিলের রায়।
Published : 02 Nov 2014, 02:24 PM
অনলাইনে প্রকাশিত আপিল বিভাগের সোমবারের কার্যতালিকার শীর্ষেই রয়েছে এই জামায়াত নেতার মামলাটি।
সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কুদ্দুস জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রায় আগামীকাল হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।”
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ গত ১৭ সেপ্টেম্বর এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।
ওইদিনই আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের দলের আরেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায় দেয়, যাতে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে ট্রাইব্যুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতের অপর নেতা আবদুল কাদের মোল্লা আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পান, যা ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালতে কামারুজ্জামানের মামলার শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আশা প্রকাশ করেন, একাত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর এই বদর নেতার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে।
শুনানিতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সহায়তাকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ইকরামুল হক টুটুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আদালতে বলেছি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং দালিলিক প্রমাণাদির ভিত্তিতে একাত্তর সালে কামারুজ্জামানের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই ন্যায় বিচারের স্বার্থে তার সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল থাকা উচিৎ।”
কামারুজ্জামানের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সংবাদপত্র, এমনকি জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের প্রতিবেদনেও এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে আসামির আইনজীবী এসএম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, “প্রসিকিউশন তাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে কোনো অভিযোগ নির্ভরযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।”
আপিলের রায়ে কামারুজ্জামান খালাস পাবেন বলেও আশা করছেন তার আইনজীবী।
একাত্তরে আল বদরের ময়মনসিংহ জেলা শাখা প্রধান কামারুজ্জামানকে গত বছর ৯ মে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। গত ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালে আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় আপিল করেনি।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে হত্যা ও গণহত্যার দুটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আরো দুটি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীকে সংগঠিত করেন বলে যে তথ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন উপস্থাপন করেছে- আসামির আইনজীবীরা তা খণ্ডাতে পারেননি।
প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন। ২২ এপ্রিল তিনি জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনী বৃহত্তর ময়মনসিংহে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ ঘটায়।
এর পক্ষে প্রসিকিউটররা দৈনিক সংগ্রামের সেই সময়ের একটি প্রতিবেদনও উপস্থাপন করেন।
রায়ের একটি অংশে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া বলেন, “আসামির আইনজীবীরা প্রসিকিউশনের এ বক্তব্য খণ্ডাতে পারেননি।”
হত্যা ও গণহত্যার দায়ে ফাঁসি
প্রসিকিউশনের তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের নারীরা।
আর চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৩ অগাস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়।
মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগী নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।
গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, “আসামি যেভাবে এসব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে সুবিচার হবে না।”
এ দুটি ঘটনায় হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন বিচারক।
দুই ঘটনায় যাবজ্জীবন
প্রসিকিউশনের প্রথম অভিযোগে বলা হয়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তর সালের ২৯ জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।
এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
আর সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়।
এ দুটি ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে কামারুজ্জামানকে।
শিক্ষক নির্যাতন: ১০ বছরের সাজা
একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এই মামলায় দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়।
ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। আর একই বছর ২ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এই জামায়াত নেতাকে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। ৩১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেয়। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
যুদ্ধাপরাধী থেকে শিবিরের সভাপতি
কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। তার বাবা ইনসান আলী সরকার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী।
১৯৭১ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র কামারুজ্জামান ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি।
এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।
জামালপুরে আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে।
স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
জিয়ার আমলে ছাত্রসংঘের নাম বদলে শিবির করার পর অবশ্য প্রথমে কামারুজ্জামান সেক্রেটারি ছিলেন। ওই সময় সভাপতি ছিলেন মীর কাসেম আলী। ট্রাইব্যুনালের রায়ে রোববার তারও মৃত্যুদণ্ড হয়।
১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।
১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন।