বিচার বিভাগ ‘রক্ষার’ উদ্যোগে শুরুতেই হোঁচট

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আইনপ্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধান সংশোধনের বিরোধী আইনজীবীদের সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।

সুলাইমান নিলয়মুনীরুল ইসলাম ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2014, 01:47 PM
Updated : 10 Sept 2014, 05:56 AM

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে এক সভায় সরকারের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে বিভিন্ন দলের আইনজীবীরা এক মঞ্চে উঠলেও কমিটি ঘোষণা করার পরই গোল বাঁধে।

সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদভুক্ত গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির ওই সভায় আকস্মিকভাবে ড. কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে আইনজীবীদের ‘সর্বদলীয় কমিটি’ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন এই কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আওয়ামী সমর্থক আইনজীবীদের নেতা এম আমীর-উল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদের নামও ঘোষণা করেন।

সভায় অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখলেও পরে আমীর ও রোকন দুজনই বলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে এই কমিটির ঘোষণা দেয়ায় তারা এতে থাকছেন না।

সভার সভাপতি গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির একাংশের সভাপতি সুব্রত চৌধুরীও কমিটি ঘোষণা করার বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন। একে ‘তাৎক্ষণিক’ ঘোষণা বলছেন তিনি। 

অন্যদিকে সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল দাবি করে খন্দকার মাহবুব বলেছেন, কমিটি ঘোষণার সময় থাকলেও ‘রাজনৈতিক চাপে’ সিদ্ধান্ত বদলেছেন আমীর ও রোকন।

বিচারক অপসারণের বিধান ১৯৭২ সালের সংবিধানের মতো আইন প্রণেতাদের হাতে দিতে গত রোববার সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, যা চলতি অধিবেশনেই পাস হওয়ার কথা রয়েছে।

সংসদের বাইরে থাকা দল বিএনপির আপত্তির মধ্যে সংবিধান সংশোধনের এই প্রস্তাব উত্থাপনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ড. কামালসহ চারজন আইনজীবী এই উদ্যোগের সমালোচনা করেন।

গণফোরাম সভাপতি কামালের সঙ্গে বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ’৭২ এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর এবং আওয়ামী আইনজীবীদের সমর্থনে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ব্যারিস্টার রোকনও ছিলেন।

তাদের মতোই সরকারের এ উদ্যোগের সমালোচনাকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিককেও খন্দকার মাহবুব ঘোষিত কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রাখা হয়েছে।

এই কমিটিতে আমীর, রোকন ও শাহদীনের সঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আরো রাখা হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে।

কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে।

কমিটি ঘোষণাকারী খন্দকার মাহবুব বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন। সাবেক সংসদ সদস্য খোকন বিএনপির যুগ্মমহাসচিব।

খোকনের সঙ্গে সহকারী সদস্য সচিব হিসাবে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মোর্চা সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের নেতা সুব্রত চৌধুরী।

সুব্রত চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় উল্লিখিত আইনজীবী নেতাদের সবাই থাকলেও দেখা যায়নি সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের আব্দুল বাসেত মজুমদারের পক্ষের কাউকে।

আমীর ও বাসেতের নেতৃত্বে আওয়ামী আইনজীবীরা বেশ কিছুদিন ধরেই দ্বিধাবিভক্ত। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গত নির্বাচনে তাদের এক করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।

আমীর-রোকনের ‘না’

আলোচনা সভায় কমিটি ঘোষণার সময় আমীর ও রোকন উপস্থিত থাকলেও পরে তারা দুজনই জানান, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করায় এই কমিটির কাজে তারা অংশ নেবেন না।

ব্যারিস্টার আমীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কমিটি ঘোষণার জন্য তো আমরা সেখানে যাইনি। আমরা একটি মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। এই কমিটির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই।”

“আমি আগেও বলেছি, আমি কোনো কমিটিতে থাকব না। পরেও বলেছি, কোনো কমিটিতে থাকব না,” বলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য।

গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির এই সভায় কমিটি গঠনের কোনো আলোচ্যসূচি ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, “কমিটি হওয়ার কোনো এজেন্ডাও ছিল না। আর খন্দকার মাহবুব হোসেনের আমন্ত্রণে তো আমরা সেখানে যাইনি। আমরা গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম।”

ব্যারিস্টার রোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মতবিনিময় সভায় আমাকে আহ্বান করেছে, আমি সেখানে গিয়েছি। আমি আমার মত ব্যক্ত করেছি। আমি কারো সাথে কোনো আন্দোলনে নাই, আমি কোনো কমিটিতেও নাই।

“খন্দকার মাহবুব হোসেন সাহেবকে আমি সরাসরি বলেছি, আপনি আমার নাম ঘোষণা করবেন না। এটাও বলেছি, আপনি কী করে কমিটি ঘোষণা করবেন?”

কমিটি গঠন নিয়ে নিজের আপত্তির কথা সভার আয়োজকদের বলেছেন জানিয়ে রোকন বলেন, “যাদের মিটিং আমি তাদেরকে বলেছি, এগুলোতে আমার আপত্তি আছে। আমার নাম যাতে কোনো কমিটিতে ঘোষণা করা না হয়। ওরা বলেছে, ‘আমরা তো কোনো কমিটি করি নাই’।

“আমি আলোচনা সভায় গিয়েছি, আমার মত দিয়েছি। আমার কথা সরকারকে মানতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে নাকি? আমি কি এখানে আন্দোলনে গিয়েছি নাকি।”

“আর খন্দকার মাহবুব হোসেন কে? এটা তো তার মিটিং না। এটা তো সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন না। ওনারা ঘর পোড়ার মাঝে আলু পোড়া দিয়েছেন।”

‘চাপে পিছু হটেছেন আমীর-রোকন’

খন্দকার মাহবুব দাবি করেছেন, কমিটি ঘোষণার সময় উপস্থিত আমীর ও রোকন আপত্তি না করলেও পরে তারা হয়তো রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন।

“সকলের উপস্থিতিতেই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সময় তারা এর বিরোধিতা করেননি। এখন হয়তো ওনাদের উপর রাজনৈতিক চাপ এসেছে। সে কারণে তারা এমন কথা বলছেন,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।

খন্দকার মাহবুব বলেন, “এখন কমিটিতে তারা ইনক্লুড হয়ে গেছেন। তবে চাইলে তারা পদত্যাগ করতে পারেন।”

তিনি দাবি করেন, কামাল হোসেন ও সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেই এ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

‘এটা তাৎক্ষণিক কমিটি’

কমিটি ঘোষণার বিষয়ে সভার আয়োজক সংগঠনের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা হঠাৎ করেই হয়ে গেছে।

“অন দ্য স্পট করেছে ফেলেছে। এটা এইভাবে হবে না। কারণ মিটিংটা তো ছিল আমাদের। উনি (মাহবুব) ঘোষণা করে ফেলেছেন। ওইভাবে জিনিসটা হবে না।”

তিনি বলেন, এই আন্দোলন এগিয়ে নিতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতিরা কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন।

তাহলে এই কমিটি থাকবে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে সুব্রত বলেন, “এটা ঠিক করবেন সাবেক সভাপতিরা। তারা মনে করলে থাকবে, না মনে করলে থাকবে না। এটাই আমাদের অবস্থান।”

কমিটির বিষয়ে ড. কামালের সঙ্গে যোগাযোগে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তার চেম্বারে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে বলা হয়, “রাজনৈতিক বিষয়ে আমরা জানি না। আমরা কেবল আইনগত বিষয়ে বলতে পারব।”

টেলিফোনে পাওয়া যায়নি শাহদীন মালিককেও।

‘সুপ্রিম কোর্ট পরিপক্ক না হওয়ায় ওই বিধান ছিল’

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় যে বিধান করেছিলেন, এখন তার বিরোধিতার ব্যাখ্যায় ব্যারিস্টার আমীর বলেন, তখন সুপ্রিম কোর্ট ‘পরিপক্ক’ ছিল না বলে ওই বিধান ছিল।

সভায় আলোচনায় তিনি বলেন, “সংবিধান প্রণয়নেরর সময় ৯৬ অনুচ্ছেদ (বিচারকদের অপসারণ) সংসদের কাছে রেখেছি। কারণ তখন সুপ্রিম কোর্ট ম্যাচিউরড হয়নি।

“৭২ এর সংবিধানে ৯৫ (২)(গ) এ বিচারক নিয়োগে আইনের কথা বলেছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। লন্ডনে বিজ্ঞাপন দিয়ে ইন্টারভিউ করে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়।”

১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের পদের মেয়াদ নির্ধারণ ও তাদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়।

এখন সংবিধান সংশোধন করে আবার সংসদের হাতে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাইছে আওয়ামী লীগ।

আলোচনায় ড. কামাল তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন না করার আহ্বান জানান।

তিনি আইনমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, “আইনমন্ত্রী এ অঙ্গনে অনেক দিন প্র্যাকটিস করেছেন। উনি তো ওখানে গিয়ে আইন ভুলে যেতে পারেন না।

“সংবিধান সংশোধন করতে সময় নিতে হবে। ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে কেন করতে হবে? আলোচনা বিচার বিবেচনা করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।”

সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করলেই তা বৈধ হয় না বলে সরকারকে সতর্ক করে ড. কামাল বলেন, “১৯৮৮ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই ৮ম সংশোধনী করা হয়েছিল, পরে সেটা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অসাংবিধানিক হতে পারে।”

আওয়ামী লীগ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছেলে ব্যারিস্টার মঈনুল আলোচনায় বলেন, “আমি জন্মসূত্রে আওয়ামী লীগার। সোহরাওয়ার্দী, মানিক মিয়া এ আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ নেই।

“এ আওয়ামী লীগ একবার গণতন্ত্র হত্যা করেছে, এখন আরেকবার করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে ১৫৩ জন নির্বাচন ছাড়াই সংসদ সদস্য হয়েছে। সে সংসদ অবৈধ। তারা যে সমস্ত আইন করেছে সেগুলোও অবৈধ।”