বাংলাদেশে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়ে একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণসহ অন্যান্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক সংঘাত’ বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা।
Published : 28 Apr 2014, 02:37 PM
আর এসব ঘটনা বাঙালিদের ‘অন্তর্কলহের’ ফল বলেও দাবি করেছেন তিনি।
‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকায় ‘বাংলাদেশে প্রহসনের বিচার’ শিরোনামে লেখা ওই নিবন্ধে একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তোলেন পাকিস্তানের সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। একে আওয়ামী লীগের ‘প্রচারণা’ বলে দাবি করেন তিনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত পরিকল্পিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংগ্রাম’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির শাসনামলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বৈরী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায় বলেও দাবি করেন এই পাকিস্তানি।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা হানিফ বর্তমানে ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইন্সস্টিটিউটে (আইপিআরআই) কর্মরত, যে প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত বলে পরিচিত।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার বক্তব্য উদ্ধৃত করে হানিফ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাতিষ্ঠানিক রূপই ‘এটাকে নিয়ে অনেক বেশি সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।’
কিন্তু হানিফের বক্তব্যের যে দিকটি সবাইকে হতবাক করার মতো তা হলো, তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ‘নিরপরাধ’ (ধোয়া তুলসি পাতা) হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
“তারা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং বেসামরিক জনগণ ও নিরপরাধ মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি,” বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ নেতারা ‘ভারতের নির্দেশনায়’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের আওয়াজ তুলছেন বলে দাবি তার।
‘সন্ত্রাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নির্বিচারে হত্যা, নিপীড়ন ও মানুষকে নির্যাতন করেছে’ বলেও দাবি করেন তিনি।
এই পাকিস্তানি এমন এক সময় এসব অভিযোগ করলেন যখন ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যারা গণহত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ার পর পাকিস্তান পার্লামেন্টও একটি প্রস্তাব পাস করে। এরপর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য পাকিস্তানি দূতকে কঠোরভাবে বলে দেয়া হয়।
পাকিস্তানে সাবেক কর্নেল হানিফ তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “যাই হোক, হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন, ধর্ষণ এবং অন্যান্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা অবশ্যই ১৯৭১ সালে হয়েছিল। সেগুলো প্রকৃত অর্থে ঘটিয়ে ছিল সেইসব বাঙালি গোষ্ঠীগুলো, যারা এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। আর তার অধিকাংশের দায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের, যারা ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে সমর্থন আদায়ের জন্য নির্বিচার হত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছে এবং মানুষকে অপদস্ত করেছে।”
তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে নৃশংসতা ঘটেছিল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রতিক কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রাজনীতির ব্যাপারে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংঘাতের পর্যালোচনা জরুরি।”
তিনি আরো বলেন, “আওয়ামী কর্মী-সমর্থকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বিহারি, বিএনপি এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগ আনে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলে। কিন্তু যেসব বাঙালি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা আওয়ামী নেতারা চালিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে এমন প্রচেষ্টা তারা দেখান না।”
তিনি দাবি করেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সচেতন ছিল। তারা প্রাথমিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। পরে তারা ভারতের পরিকল্পনায় গেরিলা লড়াইয়ে নামা আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে এবং তারপর ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
“যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই ছিল না পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এসব অভিযানে। ভ্রাতৃঘাতীমূলক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতেও ব্যাপক প্রচেষ্টা নিয়েছিল তারা।
তিনি বলেন, “বিএনপি মনে করে, জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে তড়িঘড়ি করে বিচার করার পিছনে বাংলাদেশের তরুণদের বিভ্রান্ত করে ভোট অর্জন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল কাজ করেছে।”
“অভিযুক্তরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না বলে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে।”
পাকিস্তানি কর্নেল বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ পক্ষপাতদুষ্ট করে এবং আইনের সংশোধনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার অভিযুক্তদের ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করেছে।”
এছাড়া পাকিস্তানের সাবেক কয়েক সেনা কর্মকর্তার বিচার শুরু করতে জেনেভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ দায়েরের জন্য আওয়ামী লীগ কয়েকটি ‘ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দলকে’ ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পায়নি দাবি করে তিনি বলে, “অতীতের সঙ্গে সমঝোতা করে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কাজ করার বদলে তা অভ্যন্তরীণ অনৈক্যকেই বাড়িয়ে তুলতে এগুলো করা হয়েছে।
“এর মধ্য দিয়ে এটারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়া তুলতে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তরিক নয়।”