যুদ্ধারাপধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে আন্দোলন চালিয়ে নিতে জনগণের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান শহীদ জননী নামে পরিচিত লেখক জাহানারা ইমাম, কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই দায়িত্বের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
Published : 13 Dec 2013, 01:43 AM
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়।
বিক্ষোভের অংশ হিসাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শফী ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক।
কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ 'গণআদালত' গঠন করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের 'নরঘাতক' গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার শুরু করে।
গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম তার (গোলাম আযম) ১০টি অপরাধই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
এই গোলাম আযমই ৯০ বছরের কারাদণ্ড পেয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
ওই সময় জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
গণআদালতের অন্য সদস্যরা ছিলেন- অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান ও আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান প্রমুখ।
গণআদালতের এই বিচার পরিচালনা করায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার জাহানারা ইমাম ও সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে।
‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘শহীদ জননী’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধে ছেলে গেরিলা যোদ্ধা রুমিকে হারানো এই মা।
লেখক জাহানারা ইমাম(ডাক নাম জুডু)১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আব্দুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআদালতের প্রধান উদ্যোক্তা জাহানারা ইমাম মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মারা যান।
জাহানারা ইমামের আত্মজীবনীমূলক লেখা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অসাধারণ দলিল হিসেবে দেখেন ইতিহাসবেত্তারা।
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার' ও 'কমর মুষতারী সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা বাংলা বসন্ত নামে পরিচিত শাহবাগ গণজাগরণেও প্রেরণায় ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়ার পর গড়ে উঠা শাহবাগের বিক্ষোভ বিরতিহীনভাবে ২০০ ঘণ্টায় পা দেয়ার পূর্বক্ষণে এই প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।
১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় শাহবাগ মোড়ে মৎস্যভবনমুখী রাস্তায় স্থাপন করা হয় শহীদ জননীর প্রতিকৃতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে দুই যুগ আগে যিনি মাঠে নামতে শিখিয়েছিলেন সবাইকে।
নিলয়, তাহসিন, শুভ্র, সৌমিকের মতো কয়েকজন তরুণের উদ্যোগে চারুকলার শিল্পীদের তুলির আঁচড় আর বুয়েটের স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় স্থাপন করা হয় এই প্রতিকৃতি। তিনদিন ধরে এতে শ্রম দেয় ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী।
উদ্যোক্তা তরুণরা শহীদ জননীর ছেলে রুমীর নামে গড়ে উঠা ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’র ব্যানারে এই প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক এই যুদ্ধাপরাধী পলাতক থাকায় এই মামলার আপিল বা রায় কার্যকরের দিকে যায়নি।
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়। পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার এই রায় কার্যকর হয়।
শহীদ জননী তার শেষ চিঠিতে বলেন, “সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরূদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসি অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম।
“আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাব না। মরণ ব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গিকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই।
“আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান- সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।
“এই আন্দোলনকে এখনো দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নয়।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী নেই’ মন্তব্য করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ সমালোচনার ঝড় তোলেন।
এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের উদ্যোগে গঠিত হয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলনে শরিক হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারে স্থান পায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে তরুণ প্রজন্ম ব্যাপক সাড়া দেয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহুল প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
ওইদিন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। পরে আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
এই দুই ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত মোট ৯টি রায়ে ৭জন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। একজনকে ৯০বছর কারাদণ্ড, একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডিতদের মধ্যে তিনজন পলাতক রয়েছেন।