‘অভিযোগ গঠন ছিল দুর্বল, তদন্তে ছিল ত্রুটি ’

মামলার অভিযোগ গঠনে দুর্বলতা ও তদন্তে ত্রুটির কারণেই খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান মুদ্রা পাচার মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2013, 03:38 PM
Updated : 17 Nov 2013, 07:23 PM

ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোতাহার হোসেন রোববার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

ঘুষ হিসাবে আদায়ের পর ২০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে দুদকের এই মামলায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক বেকসুর খালাস পেলেও তার বন্ধু বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর দায়ের করা এ মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১১ সালের ৬ জুলাই।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ নির্মাণ কনস্ট্রাকশনস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন মামুন।

২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পন্থায় ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে মামুনের হিসাবে পাচার করা হয়, যার মধ্যে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তারেক খরচ করেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।

৩৭ পৃষ্ঠার রায়ের শেষ অংশে বলা হয়, ওই টাকা খরচ করার কথা তারেক রহমান অস্বীকার করেননি। ২০০৭ সালে দুদকে দাখিল করা তারেকের হিসাব বিবরণীতে তার উল্লেখ রয়ছে। তিনি যে মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন তা প্রমাণ হয়নি।

এই মামলার রায় বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্ট আদালতের একজন জ্যেষ্ঠ  আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলত মামলার অভিযোগ গঠনের দুর্বলতা এবং ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের কারণেই যে তারেককে খালাস দিতে হয়েছে, রায়ের পর্যবেক্ষণে এটা স্পষ্ট।”  

রায়ে বলা হয়, প্রধান সাক্ষী নির্মাণ কনস্ট্রাকশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদিজা ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ঘুষ নয়, ‘কনসালটেন্সি ফি’ হিসাবে মামুনকে তিনি ওই অর্থ দিয়েছিলেন। মামুনও আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে ওই টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

“কিন্তু অর্থ ফি হিসাবে নেয়ার মতো কনসালটেন্সি ফার্ম মামুনের ছিল না। ওই টাকা অনৈতিকভাবে চাপ দিয়ে নেয়া হয়েছে মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা হয়েছিল। এ কারণে ওই টাকা দেশে গ্রহণ করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে- এমন আশঙ্কায় বিদেশে টাকা গ্রহণ করা হয়, যা মানি লন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”

বিচারক রায়ে বলেন, তারেক টেন্ডারের কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য ঘুষ দাবি করেছেন বা চাপ দিয়েছেন- এমন কথা খাদিজা আদালতে বলেননি। তারেক রহমান ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি, তার টাকা নেয়ার কোনো ‘দালিলিক সাক্ষ্য প্রমাণও’ হাজির করা হয়নি।

“আসামি মামুনের মাধ্যমে খাদিজার কাছ থেকে অর্থ দাবি করার কোনো প্রমাণ তারেকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয় না। সিঙ্গাপুরে সিটি ব্যাংকে তারেকের নামে কোনো একউন্ট থাকার কথাও বাদি দাবি করেননি।”

সব মিলিয়ে তারেক ভয় দেখিয়ে মামুনের মাধ্যমে অর্থ আদায় করেছেন- এ অভিযোগ প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।                   

এ কারণে মামুনকে মুদ্রা পাচার আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি- সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হলেও তারেককে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।    

রায়ের আগে আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা

 

বিচারক আদেশে বলেন, মামুনের সাজা থেকে তার হাজতবাসকালীন সময় বাদ যাবে।

আর মামুনের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাব থেকে ফিরিয়ে আনা ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। দুটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় তা বিজ্ঞাপন আকারেও প্রচার করতে হবে।

২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের বক্তব্য শোনে আদালত। 

এছাড়া অভিযোগপত্রের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কর্মকর্তা ডেবরা লেপরোভেট এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।

আর মামুনের পক্ষে ৫ জন এ মামলায় সাফাই সাক্ষ্য দেন।

মামলা দায়ের থেকে শুরু করে পুরো বিচার প্রক্রিয়াতেই অনুপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে  তারেক। গত পাঁচ বছর ধরে তিনি যুক্তরাজ্যে রয়েছেন।

জরুরি অবস্থা জারির পর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পরের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যান।

সে সময় তার বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হলেও এই প্রথম কোনো মামলার নিষ্পত্তি হলো।