যুদ্ধাপরাধ: হবিগঞ্জের শফির প্রাণদণ্ড, তিনজনের আমৃত্যু সাজা

মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এক আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2022, 05:49 AM
Updated : 30 June 2022, 12:04 PM

বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার এবং কে এম হাফিজুল আলম।

এ মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে হবিগঞ্জের লাখাইয়ের মো. শফি উদ্দিন মাওলানাকে মৃত্যুদণ্ড এবং মো. জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, মো. সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া ও তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় আরেক আসামি সাব্বির আহমেদকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

আসামিদের মধ্যে শফি উদ্দিন এবং সাব্বির আহমেদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ও আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।

আসামিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষ হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধের দুটি অভিযোগ আনা হয়েছিল।

এর মধ্যে এক নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে শফি, জাহেদ, সালেক ও তাজুলকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

আর দুই নম্বর অভিযোগে শফিকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিন আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।

যে দুই অভিযোগে সাজা

১. একাত্তরের ৩১ অক্টোবর রাত ২টায় আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানা সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এন এ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশপাশের আরও ১০ থেকে ১২টি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। এবং গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়।

২. একাত্তর সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানাসহ অন্যান্য রাজাকার ও একদল পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস কামালের বাবা মো. ইদ্রিস মিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহানের বাবা আব্দুল জব্বারকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।

বিচার পরিক্রমা

ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের ২২ মার্চ মানবতাবিরোধী বিরোধী এই অপরাধের তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

এর দেড় বছর বাদে ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। পরে তিন আসামি জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া, সালেক মিয়া ওরফে সায়েক মিয়া এবং তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১৮ সালের ২১ মার্চ এ মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিলে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়।

মামলার অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ থেকে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে চলে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত।

এই সময়ের মধ্যে মামলায় সাক্ষী দেন নয় জন। এর পর ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়ে ১৭ মে শেষ হয়। ওইদিন রায়ের জন্য মামলাটি অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ গঠনের পর দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত ১৭ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।

রায়ে প্রাথমিকভাবে সন্তুোষ প্রকাশ করলেও পরে পর্যালোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে বলে জানান প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।

তিনি বলেন, “যাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি এবং একজনকে খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে আমরা চিন্ত করব।”

সাজাপ্রাপ্ত চার আসামির আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ানের দাবি, তার মক্কেলদের ফাঁসানো হয়েছে।

তিনি বলেন, “২০১০ সালে সৈয়দ কায়সারের মামলা চলছিল, তখন হবিগঞ্জ জেলায় একটি রাজাকারের লিস্ট তৈরি করা হয়। সেই তালিকায় আমার আসামিদের কারো নাম ছিল না। পুনরায় ২০১৭ সালের আরেকটি তালিকা তৈরি করে আমার আসামিদের ফাঁসানো হয়েছে।

“অর্থাৎ তদন্ত সংস্থা যাকে ফাঁসাতে চায় বা আসামি করতে চায় তাকে ফাঁসানোর জন্য এক জেলা বা এক উপজেলায় বার বার করে রাজাকার লিস্ট তৈরি করে।”

এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, “আমরা মনে করি, আজকে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তাতে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। আশা করছি উচ্চ আদালত থেকে তারা খালাস পাবেন।”

খালাস পাওয়া সাব্বির আহমেদের আইনজীবী এম এইচ তামিম বলেন, “এই মামলায় সাব্বির আহমেদ ন্যায়বিচার পেয়েছেন। পলাতক থেকেও ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এজন্য ট্রাইব্যুনালের ওপরে আমি এবং আমার মক্কেল কৃতজ্ঞ।”

৪৬ রায়ে মৃত্যুদণ্ড ৭৮, আমৃত্যু কারাদণ্ড ২৫ এবং খালাস ২

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম রায় আসে ২০১৩ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪৬টি রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এর মধ্যে রায়ের আগেই মারা যান ১৪ জন।

ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন ৭৮ জন, ২৫ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। এছাড়া চার জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ছয় জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বয়স বিচেনা করে এখন পর্যন্ত দুই আসামি ট্রাইব্যুনাল থেকে খালাস পেয়েছেন।

বৃহস্পতিবারের রায়ে হবিগঞ্জের লাখাইয়ের সাব্বির আহমেদ ছাড়া এর আগে অপরাধ সংঘটনের সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের তললী গ্রামের আব্দুল লতিফকে খালাস দেয়।