প্রকাশের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অমর একুশে বইমেলায় একটি চত্বরে স্থায়ী আসন গড়ে উঠলেও অল্প কিছু ক্রেতা আর পাঠকের হাত ধরেই এগিয়ে চলছে ছোট কাগজের সাহিত্য আন্দোলন।
Published : 01 Mar 2022, 07:03 PM
কেবলমাত্র লেখনী আঁকড়ে ধরে চিন্তার নতুন একটি ভাষা তৈরির চেষ্টায় সংকট ও সংগ্রামের মধ্যেও লিটল ম্যাগে লেখা চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে অটল থাকার কথা জানিয়েছেন নতুন-পুরনো অনেক লেখক।
অতীতের রমরমা দিন পেরিয়ে কয়েক বছর ধরে নানা সংকট পাড়ি দিচ্ছে গতানুগতিকের বাইরের এই সাহিত্য ধারা। প্রকাশকদের দাবি সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরতে ‘আন্দোলন’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন।
আয়ু বেশি দিন না হলেও দিন দিন লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি প্রকাশকদের। এবার একুশে বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২৭টি প্রতিষ্ঠানকে।
২৬ বছর ধরে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কাজ করছেন ‘দ্রষ্টব্য’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সামাজিক অবক্ষয়,শোষণ-বৈষম্য, ক্ষমতার প্রভাব-এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করলে আপনার লেখা সবাই পড়বে, তেমনটা আশা করা যায় না।
“অনেকে দেখবেন রূপকথা বা প্রেমের গল্প বেশি পড়ছে। তাই বলে কি আমাদের পাঠক নেই, আমাদেরও পাঠক আছে। তা না হলেও গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ এই ছোট কাগজ বের করত না।”
কামরুল হুদা পথিক বলেন,“কোনো বড় প্রকাশনা আমাকে একটি উপন্যাস লিখতে বললে আমি কিন্তু লিখব না। আমাকে এখন দিতে পারে, আমাকে নষ্ট করার জন্য...
“লিটল ম্যাগাজিন একটা মুভমেন্ট, একটা সক্রিয় মুভমেন্ট। লিটল ম্যাগাজিনের মুভমেন্ট যারা করে আসছে, তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের চিন্তাটা আমরা মাথায় ধারণ করেছি।”
অনলাইন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে লেখালেখি এবং পত্র-পত্রিকার সাময়িকীতে লেখক ও পাঠকের লেখার আগ্রহ বেশি হওয়ায় লিটল ম্যাগ তার আগের অবস্থান হারিয়েছে।
ডিজিটাল যুগের প্রভাবে ছোট কাগজের গুরুত্ব তরুণ প্রজন্ম বুঝতে পারছে না বলে মনে করেন এক সময়ের লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবি রাসেল আশেকী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন “এই ছোট কাগজে লিখেই আমরা আজ লেখক হয়েছি।”
“যারা এক সময় লিটল ম্যাগে লিখতেন, তারা এখন ফেসবুক বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লিখছেন। ইউটিউবে কন্টেন্ট বানাচ্ছেন। তারপরও আমরা কিন্তু লিটলম্যাগ ছেড়ে দিইনি, পথচলা থেমে যায়নি।”
‘অনুভূতি’ নামে একটি ছোট কাগজের লেখক নাহার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিটল ম্যাগের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে বলা যাবে না। তরুণ ছেলে-মেয়েরা অনেকে আগ্রহী হয়েছেন।
“অর্থের কারণে অন্য জায়গায় তাদের বই প্রকাশ করতে কষ্ট হয়, সেখানে লিটলম্যাগে তারা সহজেই অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। একটা লিটম্যাগ যখন বের হয়, তখন তারা খুব আনন্দের সঙ্গে তারা কিনতে আসেন।
“লিটলম্যাগ একজন লেখকের শেকড়, এখান থেকে ধীরে ধীরে তার লেখক সত্ত্বার বিস্তৃতি লাভ করে। যার জন্য আমি সব সময়ই স্বাগত জানাই, সবাই যাতে লিটল ম্যাগে আগ্রহী হয়।”
ব্যক্তিগত কিংবা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র চিন্তাধারাকে প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম। নতুন লেখকরা নিজেদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখে নিজেরাই প্রকাশক হিসেবে ভূমিকা রাখতেন।
নতুনদের এ লেখা পাঠক সমাজে সুনামও কুড়িয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় লেখকই উঠে এসেছে ছোট কাগজে সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে।
লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রা শুরুর সময়কাল উনিশ শতক, আমেরিকা এবং ইউরোপে। বাংলা ভাষীদের কাছে সাহিত্যের এই মাধ্যমকে প্রথম পরিচিত করে দেন বুদ্ধদেব বসু।
বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ধারার প্রথা ভেঙেছিল ‘সবুজ পত্র’ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা পত্রিকা’। নতুনের আবাহনে এসেছিল ‘কালি ও কলম’, ‘শিখা’ কিংবা ‘শনিবারের চিঠি’।
এখনও বোদ্ধা লেখকদের স্মৃতিসম্ভারে আলো ছড়াচ্ছে কল্লোল যুগের লিটল ম্যাগ। সিকান্দার আবু জাফরের ‘সমকাল’, আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের ‘কন্ঠস্বর’ নতুন নতুন লেখক ও কবি তৈরিতে অগ্রণী হয়েছে।
১৯৯৯ সাল থেকে ‘সরলরেখা’ নামক ছোট কাগজের সম্পাদনা করছেন রিসি দলাই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রথম কথা হলো আমরা এগুলো বিক্রির জন্য করিনা।
“সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা, সম্ভাবনাময় লেখকদের পাঠকের সামনে নিয়ে আসাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কাগজে লেখনীর মাধ্যমে অনেক সময় সরকারকে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বার্তা দেওয়া হয়।
“সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে সংশোধন করে, আবার অনেক সময় করেও না। কিন্তু আমরা আমাদের কথাগুলো বলি। এতে নতুন লেখক, নতুন কথা ও নতুন স্বর তৈরি হয়।”
স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে ‘প্রতিভাপত্র’ নামে একটি ছোট কাগজ বের করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ইসিয়াম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,“লিটলম্যাগ আন্দোলন মূলত পুঁজিবাদ, পণ্যমুখী সমাজ, পণ্যমুখী সাহিত্য ও কালচারের বাইরে গিয়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য কিছু করতে চায়।”
লিটল ম্যাগ আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রকাশিত এ ধরনের সাহিত্যের কাগজ অর্থের অভাবে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা কঠিন বলে জানান ইসিয়াম।
এক সময়ে বাংলা একাডেমিতে বহেরা তলায় চারপাশ ঘিরে থাকা দোকানগুলো চোখ জুড়াতো পাঠক-দর্শনার্থীদের। গত দুই বছর ধরে লিটল ম্যাগ চত্বরের জায়গা বরাদ্দ হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের পাশে।
গতবছর প্রথমে মেলার পূর্বদিকে রমনা কালীমন্দিরের পেছনে জায়গা দেওয়া হলেও আন্দোলনের মুখে আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসে লিটল ম্যাগ চত্বর।
অমর একুশে বইমেলার নিয়ম অনুযায়ী,লিটলম্যাগ চত্বরে ছোট কাগজ ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশনীর বই বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু বাংলা একাডেমির সেই নিয়ম মানছে কিছু কিছু স্টল।
এ বিষয়ে লিটল ম্যাগ চত্বরের দায়িত্বে থাকা বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা আমিনুর রহমান সুলতান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লিটল ম্যাগ স্টলে মাগাজিন ছাড়া অন্য প্রকাশনীর বই বিক্রির নিয়ম নাই।
“তবে কিছু কিছু স্টলে অন্য প্রকাশনীর বই বিক্রি করছে, এটা রোধ করা কঠিন। তারপরও আমরা নিয়মিত চেক করে থাকি।”