নতুন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন, তাদের নামের প্রস্তাব সবার কাছে চেয়েছিল সার্চ কমিটি; ৩২২টি নাম জমা হয়েছে, এখন রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশের জন্য নাম চূড়ান্তের পালা।
Published : 14 Feb 2022, 11:44 PM
মঙ্গলবার সার্চ কমিটির বৈঠকেই ওই তালিকা চূড়ান্ত হবে বলে আভাস দিয়েছিলেন কমিটির সচিবের দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
তবে সোমবার সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে মঙ্গলবার গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে একটি বৈঠক হবে বলে জানানো হয়েছে।
ফলে চূড়ান্ত সুপারিশের জন্য মঙ্গলবার নামের তালিকা চূড়ান্ত হবে কি না, তা এখন আর নিশ্চিত নয়; যদিও কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন সোমবারই মেয়াদ পূর্ণ করে বিদায় নিয়েছে।
ছয় সদস্যের এই সার্চ কমিটির পরবর্তী সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য ১০ জনের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব করার কথা।
ওই তালিকা থেকে অনধিক পাঁচজনকে বেছে নিয়ে রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন। তাদের মধ্যে একজন হবেন সিইসি, বাকিরা নির্বাচন কমিশনার। আর তাদের উপরই থাকবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার।
ব্যাপক আলোচনার মধ্যে ইসিতে নিয়োগের আইন হওয়ার পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সার্চ কমিটি গঠন করে দেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি কে এম ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, লেখক-অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক, মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী এবং সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন।
আইন অনুযায়ী, সার্চ কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের নামের সুপারিশ রাষ্ট্রপতিকে জমা দেওয়ার কথা। সেই হিসাবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় হাতে রয়েছে এই কমিটির কাছে।
এদিকে সোমবার নূরুল হুদারা বিদায় নেওয়ায় ইসি কমিশনারশূন্য হলেও তাতে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা নেই বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।
সার্চ কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর নামের প্রস্তাব চাইলে বিভিন্ন দল তা দেয়, ব্যক্তিগতভাবেও প্রস্তাব জমা পড়ে। বিএনপিসহ কিছু দলের জন্য সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও তারা সাড়া দেয়নি।
এছাড়া বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তিনটি বৈঠক করে সার্চ কমিটি, তাতেও অনেকের নাম আসে।
সবশেষে সোমবার রাতে সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায় থেকে ৩২২ নাম পাওয়া গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল রোববার বলেছিলেন, “তালিকা ফাইনাল হওয়ার পরে পরশু দিন মিটিং আছে (মঙ্গলবার) সেখানে বসে তালিকার বাকিসব ঠিক করা হবে।”
তবে সোমবার জানানো হয়, আমন্ত্রিত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা শনি ও রোববার বৈঠকে অংশ নিতে না পারায় মঙ্গলবার তাদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
এই বৈঠকে অংশ নেবেন বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, নিউ এইজ সম্পাদক নুরুল কবীর, ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক জাফর সোবহান, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ, মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো’র সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী, চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব শফিউল আজিম জানান, মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় তাদের নিয়ে বৈঠকে বসবে সার্চ কমিটি।
এই বৈঠক শেষে সার্চ কমিটির সদস্যরা নিজেরা বৈঠক করবেন।
নিজেদের বৈঠক শেষে কবে নাগাদ রাষ্ট্রপতির কাছে নামের সুপারিশ সার্চ কমিটি জমা দেবে, সে বিষয়ে কোনো ভাষ্য এখনও মেলেনি।
৩২২ নামের প্রস্তাব
সার্চ কমিটি যে নামের প্রস্তাব পেয়েছে, তার অধিকাংশই অধ্যাপক, বিচারপতি, সাবেক সচিব, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।
সার্চ কমিটির সদস্য সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং সাবেক কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনও আব্দুল মোবারকের নাম রয়েছে তালিকায়। ইসির সাবেক সচিব মুহাম্মদ জকরিয়া, মোহাম্মদ সাদিক, সিরাজুল ইসলাম ও মো. আলমগীরের নামও রয়েছে।
আছে ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী, সাবেক যুগ্ম সচিব বিশ্বাস লুৎফর রহমান, খন্দকার মিজানুর রহমান, মো. শাহজাহান মিয়া ও আবুল কাশেমের নাম।
সাবেক সচিবদের মধ্যে কাজী হাবিবুল আওয়াল, মোশাররাফ হোসেন ভূইয়া, আবুল কালাম আজাদ, মোস্তফা কামাল উদ্দিন, আবদুল মজিদ, নজিবুর রহমান, আব্দুল করিম, আবু আলম শহীদ খান, শেখ ওয়াহিদুজ্জামান, হেদায়েতউল্লাহ আল মামুন, আব্দুল মালেকের নাম রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের মধ্যে জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, ওয়াহহাব মিয়া, নাজমুন আরা সুলতানা, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নাম।
এরশাদ আমলের প্রতিমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন আল আজাদের নামও এসেছে প্রস্তাবে। তিনি পরে বিএনপির সংসদ সদস্য প্রার্থীও ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী সুলতানা কামাল, গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধুরী, ডা, সুফিয়া রহমানের নাম রয়েছে তালিকায়।
অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক আবুল কাসেম মোহাম্মদ ফজলুল হক, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী, শহীদজায়া মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সাদেকা হালিমের নাম রয়েছে।
নাম এসেছে অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন, আহসান মনসুর, আতিউর রহমান, মো. ফরাসউদ্দিনের।
সাবেক সেনাপ্রধান হারুনুর রশীদ, ইকবাল করিম ভূইয়া, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সালেহউজ্জামান, সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান ফখরুল আজমের নাম রয়েছে তালিকায়। সাবেক পুলিশ প্রধানদের মধ্যে রয়েছে হাসান মাহমুদ খোন্দকার, এ কে এম শহীদুল হকের নাম।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইনার ও মডেল বিবি রাসেলের নাম এসেছে নির্বাচন কমিশনে বিবেচনার জন্য প্রস্তাবিত তালিকায়।
যে প্রক্রিয়ায় বাছাই
সার্চ কমিটির কাজ সম্পর্কে আইনে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।
আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে কমিটি।
সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে তিনটি যোগ্যতা থাকতে হয়। তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে; কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় পদে অন্তত ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশিষ্টজনদের পরামর্শ
সার্চ কমিটিকে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, চাপে নত হবে না, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে।
পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী কেউ যেন স্থান না পায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতেও পরামর্শ দেওয়া হয় সার্চ কমিটিকে।
লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবাল রোববার বৈঠক শেষে বলেন, “আপনারা এমন লোক বাছাই করুন, যারা নিজের বিবেকের কাছে ঠিক থাকবেন। সাহসী থাকবেন, তারা কোনো ভয় পাবেন না। দলীয় চাপের মুখে নতি স্বীকার করবেন না, সেই ধরনের লোকই আমরা চাই।”
অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, “যিনি সৎ এবং সাহস করে কাজ করতে পারেন, এমন লোকের নাম প্রস্তাব করার জন্য বলেছি।”
পিকেএসএফের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “সৎ, সাহসী ও দুর্নীতিমুক্ত হবেন এবং সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা অথাৎ তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হবে। তারা যেন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হোন। এসব ব্যাপারে কোনো আপস নেই।”
সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবির বলেন, “সেই ব্যক্তিদের আমরা দেখতে চাই, যার মেরুদণ্ড আছে, সাহস আছে। প্রধানমন্ত্রীও যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, তাহলে তাকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে, এই সাহসী ব্যক্তিদের আমরা নির্বাচন কমিশনে দেখতে চাই।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “যার দ্বারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে সেই সাহস তারা রাখেন, সেই ধরনের লোক খুঁজে বের করুন।”
দলীয় সরকারের সুবিধাভোগীদের বিবেচনার বাইরে রাখার পরামর্শও দেওয়া হয় সার্চ কমিটিকে।
রোবারের বৈঠকে অংশ নেওয়া সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “কোনো দলীয় সরকারের সময় (এটা বর্তমান সরকারে হোক বা আগের দলীয় সরকারে হোক, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ) বিশেষভাবে সুবিধাবোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পায়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “কোনো দলীয় সরকারের অধীনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে, চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার মাধ্যমে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে কোনো কোনো সরকার তার বিশ্বস্ত লোকদের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তিরা যাতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পান।”
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনের আহ্বানের বিষয়ে জাফর ইকবাল বলেন, “এ দেশে এখনও স্বাধীনতাবিরোধী লোক আছে। তারা কি একজন স্বাধীনতার পক্ষের কোনো মানুষকে গ্রহণ করবে? কাজে সর্বজনগ্রহণযোগ্য কথাটা একটু জটিল।”
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সুপারিশ একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসি’ গঠনের, যেখানে নারী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বও থাকবে।