ওমিক্রন ফিরিয়ে আনল বিধিনিষেধের দিন

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের দাপটে সংক্রমণ ফের বাড়তে থাকায় প্রায় পাঁচ মাস পর বাংলাদেশে ফিরে এল বিধিনিষেধের কড়াকড়ি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2022, 04:31 AM
Updated : 20 Feb 2022, 10:05 AM

ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার যে ১১টি ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, বৃহস্পতিবার থেকে তা কার্যকর করা শুরু হচ্ছে।

এই বিধি-নিষেধে উন্মুক্ত স্থানে যে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ থাকবে বন্ধ। শনিবার থেকে বাস-ট্রেন আবার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলবে। রেস্তোরাঁয় বসে খেতে দেখাতে হবে টিকা সনদ।

সব ধরনের বাহনের চালক ও সহকারীদের বাধ্যতামূলকভাবে টিকার সনদধারী হতে হবে। টিকা সনদ ছাড়া ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারবে না।

অফিস-আদালতে এবং ঘরের বাইরে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। নিয়ম না মানলে শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, “মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে সবখানে। যদি কেউ মাস্ক না পরে, তাহলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাকে জরিমানা করা হবে, জেলও হতে পারে। যে কোনো পরিবহনে মাস্ক না পরে কেউ উঠবেন না।”

২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু হলে মার্চের শেষ দিকে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করা হয়, যা দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলে। সেই লকডাউনে জরুরি সেবার পরিবহন এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যে কারও চলাচল ছিল বারণ। সব অফিস আদালতের পাশাপাশি কল কারখানাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

পরিস্থিতির উন্নতিতে পরে সেই বিধি-নিষেধ শিথিল হয়। ডেল্টা সংক্রমণের পর গত বছরের এপ্রিল থেকে অগাস্ট অবধি বিভিন্ন সময় লকডাউনের বিধি-নিষেধ ছিল। তবে ‘জীবন ও জীববিকার ভারসাম্য’ রক্ষায় এ দফায় কলকারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।

এরপর সংক্রমণের হার দ্রুত কমে এলে গতবছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে; জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে।

তবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টির পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। বুধবারও শনাক্ত হয়েছে প্রায় তিন হাজার রোগী। দৈনিক শনাক্তের হারও প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা ১২ দিন আগেও ছিল ৩ শতাংশের নিচে।

নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন।

গত ১১ ডিসেম্বর জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার খবর সরকারিভাবে জানানো হয়েছিল। এখন দেশে আক্রান্তদের ‘১৫-২০ শতাংশই’ ওমিক্রনের রোগী বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের একটি অংশ চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাবে। এখনই সতর্ক না হলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেক্ষেত্রে হাসপাতালে জায়গা দিতে সমস্যা হবে।

“আমরা ধরে নিই, পাঁচ শতাংশের হাসপাতালে আসতে হয়। এরই মধ্যে হাসপাতালে রোগী আসা শুরু হয়ে গেছে। আমরা দেখব আগামী পাঁচ-সাতদিনের মধ্যেই অনেক রোগী হয়ে যাবে হাসপাতালে।

“তখন আবার একটা কষ্টকর অবস্থা তৈরি হবে। হাসপাতালে প্রেসার পড়বে, চিকিৎসক-নার্সদের ওপর প্রেসার পড়বে। সিট পেতে সমস্যা হবে, মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।”

করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনের দাপটে গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে রোগীর চাপে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।

ওই সময় দৈনিক শনাক্ত রোগী ১৬ হাজারও ছাড়িয়ে যায়, এক দিনে আড়াইশর বেশি মানুষের মৃত্যুও বাংলাদেশকে দেখতে হয়। সরকার বাধ্য হয়েছিল লকডাউনের বিধিনিষেধ জারি করতে, যদিও অনেক ক্ষেত্রে তা মানানো যায়নি।    

অর্থনীতি আর জীবিকা বাঁচাতে আগের মত সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া ‘লকডাউন’ ব্যবসায়ীরা চান না। এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, লকডাউনই সমাধান নয়, জোর দিতে হবে টিকা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতায়।

সরকারও চাইছে, দ্রুত নাগরিকদের টিকার আওতায় এনে, সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করে যতটা সম্ভব জনজীবন সচল রাখতে। দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ডোজ এবং ৩২ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। বয়স্ক ও ফ্রন্টলাইনারদের বুস্টার ডোজ দেওয়া চলছে।

যা মেনে চলতে হবে

>> দোকানপাট, শপিংমল ও বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।

>> অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে।

>> রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেল থাকার জন্য অবশ্যই করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার সনদ দেখাতে হবে।

>> ১২ বছরের বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্ধারিত তারিখের পরে টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।

>> স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বন্দরে ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। স্থলবন্দরগুলোয় আসা ট্রাকের সাথে শুধুমাত্র চালক থাকতে পারবে, কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

>> ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সব ধরনের যানের চালক ও সহকারীদের বাধ্যতামূলকভাবে করোনাভাইরাসের টিকার সনদধারী হতে হবে।

>> বিদেশ থেকে আসা যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে কোভিড-১৯ টিকাকার্ড প্রদর্শন এবং র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে।

>> স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

>> সর্বসাধারণের করোনাভাইরাসের টিকা এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার এবং উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিবে।

>> কোভিড আক্রান্তর হার ক্রমবর্ধমান হওয়ায় উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে।

>> কোনো এলাকার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবে।