আর লকডাউন নয়: এফবিসিসিআই সভাপতি

দেশে আবার করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলেও লকডাউনের মত কঠোর বিধিনিষেধ না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2022, 08:50 AM
Updated : 12 Jan 2022, 01:45 PM

বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “পৃথিবীতে এখন কোনো দেশ লকডাউন দিচ্ছে না। কারণ লকডাউনের কারণে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। গত বছর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কারণে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও আমরা জিডিপির ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।”

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাবে পুরো বিশ্বের মত বাংলাদেশেও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু বিধিনিষেধ ফিরিয়ে এনেছে সরকার।

বৃহস্পতিবার থেকে উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা সভা-সমাবেশ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ট্রেন, বাস ও লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নেওয়া যাবে। রেস্তোরাঁয় বসে খেতে, আবাসিক হোটেল থাকতে দেখাতে হবে টিকা সনদ। ১২ বছরের বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।

২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু হলে মার্চের শেষ দিকে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করা হয়, যা দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলে। সেই লকডাউনে জরুরি সেবার পরিবহন এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যে কারও চলাচল ছিল বারণ। সব অফিস আদালতের পাশাপাশি কল কারখানাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

পরিস্থিতির উন্নতিতে পরে সেই বিধি-নিষেধ শিথিল হয়। ডেল্টা সংক্রমণের পর গত বছরের এপ্রিল থেকে অগাস্ট অবধি বিভিন্ন সময় লকডাউনের বিধি-নিষেধ ছিল। তবে ‘জীবন ও জীববিকার ভারসাম্য’ রক্ষায় এ দফায় কলকারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়।

এরপর সংক্রমণের হার দ্রুত কমে এলে গতবছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে; জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে।

তবে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টির পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। বুধবার এক দিনে শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ২৯ শ ছাড়িয়ে গেছে, সেই সঙ্গে দৈনিক শনাক্তের হার পৌঁছেছে ১২ শতাংশের কাছাকাছি।

এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “নতুনভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পাওয়ার এই সময়ে লকডাউন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী সমাজ।”

গতবারের লকডাউনের কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে এখনও ১৫ শতাংশ শ্রমিক সংকটে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গত বছর ১৩ থেকে ১৪ দিন পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা চাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সুতরাং লকডাউনই সমাধান নয়, এর কারণে ক্ষতি হচ্ছে।”

তার বদলে স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “সরকার যে টিকা ছাড়া হোটেল রেস্টুরেন্টে যাওয়া কিংবা সমাবেশ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে, এটাকে আমি সমর্থন করি। আমাদের জোর দিতে হবে টিকা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতায়।”

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের প্রসঙ্গ ধরে জসিম উদ্দিন বলেন, ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে, তখন থেকে শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা আর পাওয়া যাবে না।

“তবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর আমাদের অনেক সুযোগও তৈরি হবে। সেসব সুযোগ নেওয়ার জন্য বিশেষ করে আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে।”

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে ভিয়েতনামকে অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, দেশটি ইতোমধ্যে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করছে। বিশ্বের ৩২টি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো একটি দেশের সঙ্গেও এফটিএ করতে পারেনি।

“এফটিএ পেতে হলে আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং খাতভিত্তিক দক্ষ কর্মকর্তা গড়ে তুলতে হবে।”

এজন্য তিনি ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি অফিসের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এছাড়া বেসরকারি খাত নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, পৃথিবীর ৯০ শতাংশ বাণিজ্য হয় কয়েকটি মহাদেশীয় বাজার যেমন- পূর্ব এশিয়ার রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), ইউরোপীয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ট্রেড এগ্রিমেন্টভুক্ত এলাকায়। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে টিকে থাকতে হলে এসব বাজারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

ব্যাংকগুলোকে ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাবান্ধব’ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমানে ব্যাংকগুলো বড় বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে বেশি ব্যস্ত থাকে। ছোটদের ঋণ দিতে বিশেষ নজর দিচ্ছে না। এতে দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

“কোনো কোনো ব্যাংক আছে, যারা হয়ত ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে ৫০ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই ১৫ হাজার বা ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে রাখছে। আর ছোট দুই চার লাখ কাস্টমারকে বাকি টাকা দিচ্ছে। অর্থাৎ কম পরিশ্রমে তারা ব্যবসাটা করতে চায়।”

দেশের উদ্যোক্তাদের ৮৫ শতাংশই যে এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের (এসএমই), সে বিষয়টি তুলে ধরে জসিম উদ্দিন বলেন, “বিষয়টা নিয়ে আমি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে বলেছি যে একজনকে ৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার চেয়ে ১০০ জনকে দিলে অনেক বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

“কিন্তু ব্যাংকগুলো মনে করে, ১০০ জনের কাছে যাওয়ার চেয়ে একজনের কাছে দিলেইতো আমার ব্যবসা হয়ে গেল। এভাবে দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।”

এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারকে ‘আরও কাজ করার’ আহ্বান জানিয়ে জসিম উদ্দিন বলেন, “এই জায়গায় কাজ করলে ২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্য, সেখানে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে।”

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব। ডিআরইউর সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠুও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।