তিনি বিদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শ্রম দেবেন, মাস শেষে টাকা পাঠালে সংসার চলবে, দেশের রেমিটেন্সের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু কোভিডবিধির এই কঠিন সময়ে সেই প্রবাসী শ্রমিকের বিদেশযাত্রা যেন দীর্ঘ এক ভোগান্তির নাম।
Published : 08 Jan 2022, 12:24 AM
তেমনই ভোগান্তিতে পড়াদের একজন চট্টগ্রামের মো. ফোরকান। দুবাই যাবেন বলে আগেভাগেই এসেছিলেন ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
ফ্লাইটের টিকিটের দুর্মূল্যের বাজারে ধার-দেনা করে দুবাইয়ের টিকিট কেটেছিলেন। এ কারণে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি বলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার ফ্লাইট ধরতে বুধবার রাতের বাসে তিনি চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে ভোরে ঢাকা বিমানবন্দরে আসেন।
আগেভাগে চলে আসায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিমানবন্দরের সেই ব্যবস্থা না থাকায় ছিলেন আশেপাশেই।
শুধু তিনি নন, খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ক্লান্তির পাশাপাশি খাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যেই উড়োজাহাজে সওয়ার হতে হচ্ছে ফোরকানের মত যাত্রীদের।
এরপর আবার কয়েক ঘণ্টার বিমান যাত্রা। এমন ভোগান্তির মধ্যেই প্রবাসে কাজ করতে যেতে হচ্ছে এসব রেমিটেন্স আহরণকারীদের।
বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যারা যাচ্ছেন, কোভিড পরীক্ষার বাধ্যবাধকতার কারণে তাদের বিমানবন্দরে হাজির হতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ১০ ঘণ্টা আগে। দীর্ঘ অপেক্ষার সময়টায় আশপাশের রেস্তোঁরা আর দোকানের খাবার খেয়ে অনেকে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার থেকে তৎপর হয়েছে সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিএসটিআই। বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি রেস্তোঁরা ও খাবারের দোকানকে পৌনে চার লাখ টাকা জরিমানা করেছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও খাবারের দোকানগুলো তদারক করার কথা জানিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস। মহামারীর মধ্যে সেদেশে যেতে হলে যাত্রার আগের ছয় ঘণ্টার মধ্যে কোভিড পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
যাত্রীদের কোভিড পরীক্ষার জন্য ল্যাব বসানো হয়েছে বিমানবন্দরে পার্কিংয়ের নিচতলায়। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীরা স্বাভাবিকভাবেই সময় নিয়ে কোনো ঝুঁকি রাখতে চান না। কোভিড পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন ফ্লাইট ছাড়ার ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে ভিড় করছেন কয়েকশ প্রবাসী।
বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন ফোরকানের সঙ্গে কথা হল, তখন তিনি বিমানবন্দরের পার্কিংয়ের দোতলায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভেজিটেবল রোল খাচ্ছিলেন। গায়ে শীতের কাপড়, এদিকে রোদ উঠেছে, চোয়াল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে।
দুবাইয়ের যাত্রী ফোরকান জানালেন, রাতের বাসে চড়ে ভোর ৫টায় বিমানবন্দর এলাকায় পৌঁছানোর পর বিশ্রামের জন্য আশকোনার একটি হোটেলে উঠেছিলেন। ছয় ঘণ্টা থাকার জন্য তার গুণতে হয়েছে দুই হাজার টাকা। রেল লাইনের পাশে হোটেল হওয়ায় ট্রেনের শব্দে আর হই-হল্লায় ঘুমাতেও পারেননি।
সেখানেই একটি রেস্তোঁরায় ডাল-পরোটা দিয়ে সকালের নাস্তা করে দুপুর ১২টায় বিমানবন্দরে কোভিড পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। এরপর বিমানবন্দর গোলচক্করের একটি বিরিয়ানির দোকান থেকে কাচ্চি খেয়েছেন।
বিকালের দিকে আবার ক্ষুধা লাগলে আরটিপিসিআর ল্যাবের ভেতরে খাবারের দোকান থেকে ভেজিটেবল রোল খেয়েছেন। আধলিটার পানি তাকে কিনতে হয়েছে ১৫ টাকায়। শৌচাগার ব্যবহারে প্রতিবার খরচ হয়েছে ১০ টাকা।
পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের বসার জন্য আরটিপিসিআর ল্যাবের পাশে কয়েকশ চেয়ার রাখা আছে। ভেতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তবে সেখানে ট্রলি নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না বলে অনেক যাত্রীই ব্যাগ বোঁচকাসহ বাইরে অপেক্ষা করেন।
ফোরকানের মতই দুবাই যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের তিনজন। বেলা পৌনে ৩টার দিকে পার্কিংয়ের খোলা জায়গায় বসে মোরগ পোলাও খাচ্ছিলেন তারা।
তাদের একজন আবদুল হালিম বললেন, ভোর ৬টায় কুমিল্লা থেকে রওনা হয়েছেন, মাঝে আর কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধা পেটে তেল ভর্তি মোরগ পোলাও খেতে হচ্ছে। ফ্লাইট রাত ৯টা ২৫ মিনিটে। এর মধ্যে আর কিছু খাওয়া হবে কী না কে জানে!
দুর্গন্ধের মধ্যেই খাওয়া
সৌদি আরবগামী চার নারীকে দেখা গেল মূল টার্মিনালের হাঁটাপথের ওপরে বসে দোকানের বিরিয়ানি খাচ্ছেন। তারাও দীর্ঘ সময় অভুক্ত।
বিমানবন্দরের পার্কিংয়ের দোতলায় রাখা গাড়ির ফাঁকে ফাঁকেই মুত্রত্যাগ করছেন বিদেশগামী যাত্রী এবং তাদের স্বজনদের অনেকে। যদিও নিচে শৌচাগার আছে।
ভাইকে ফ্লাইটে তুলে দিতে নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ থেকে এসেছেন গোলাপ মিয়া। তিনি বললেন, “পার্কিংয়ে একবার ঢুকলে টয়লেটে যাওয়ারও উপায় নাই। নিচে টয়লেটে গেলে পুলিশ আর উপরে উঠতে দেয় না।
“পুরুষ মানুষরা এইহনেই সাইরা ফালাইতেছে। সমস্যা হইলো মহিলাগো। এইহানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা লাগে। কিন্তু বাথরুমের কুনো ব্যবস্থা নাই।”
লিটন মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করছেন ১৫ বছর ধরে। তিনি বললেন, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের ভোগান্তি নতুন কিছু নয়।
“চারদিকে কি নোংরা দ্যাখছেন, কমলাপুরও এহন এরচেয়ে পরিষ্কার। খালি নিজের দ্যাশের বিমানবন্দরেই কোনো ইজ্জত পাইলাম না কুনোদিন। অথচ সবাই কথায় কথায় প্রবাসীগো মাথায় তুইলা রাখে।”
পার্কিংয়ের দোতলায় রাখা গাড়িগুলোতে বিদেশগামী যাত্রীদের বিদায় দিতে আসা অপেক্ষমান স্বজনেরাও ক্ষুধায় কাতর হয়ে বাইরের খাবার খাচ্ছিলেন। অনেকে অবশ্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ উল আহসান বললেন, “দূর-দূরান্ত থেকে যাত্রীরা আসেন। অনেক সময় নিজেদের সঙ্গে খাবার নিয়ে আসেন, কারণ এয়ারপোর্ট এলাকায় খাবারের দাম একটু বেশি। সেই খাবারের মান একদিন পর বা আটঘণ্টা পর ঠিক নাও থাকতে পারে।”
বিমানবন্দরের রেস্তোঁরাগুলো নিয়মিত তদারকীর মধ্যে আছে দাবি করে তিনি বলেন, “ভেতরের খাবারের দোকানগুলোতে আমরা নিয়মিত চেক করছি। স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের একটা আলাদা শাখা রয়েছে। আরটিপিসিআর ল্যাবের ভেতরে যে চারটি খাবারের দোকান রয়েছে, সেগুলোও তদারকির মধ্যে আছে। এসব রেস্তোঁরায় পচা-বাসি খাবার খাওয়ানো হয় না।”
অবশ্য বৃহস্পতিবারই বিমানবন্দরের একটি রেস্তোরাঁসহ পাঁচটি খাবারের দোকানকে জরিমানা করেছে বিএসটিআই।
বিদেশগামীদের অপেক্ষার সময়টাকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক করতে এবং তাদের খাবারের সংকট এড়াতে আশকোনার হজ ক্যাম্পটি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরীফুল হাসান।
তিনি বলেন, “বিমানবন্দরের উল্টোদিকে আশকোনায় হজ ক্যাম্পটা এখন ফাঁকা। সেখানে বিদেশগামী কর্মীদের কিছু সময় অবস্থানের ব্যবস্থা করা হলে সবারই সুবিধা হয়।
“সরকারেরই স্থাপনা এটা, বাড়তি কোনো খরচ নেই। বিমানবন্দরেরও খুবই কাছে। এখানে অনেক মানুষের একসঙ্গে অবস্থানের বন্দোবস্ত রয়েছে। বাথরুমগুলোও ভালো। এখানেই যদি বিদেশগামী কর্মীদের অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে খাবারের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকিটা কমতে পারে।”
বিমানবন্দরের উল্টোদিকে আশকোনা এলাকার পানি পরীক্ষার দাবি জানিয়ে শরীফুল হাসান বলেন, “আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, ওই এলাকার পানি পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়েছেন। পানি সরবরাহ লাইনে সমস্যা থাকতে পারে। পানির মান পরীক্ষা করে বিষয়টি যাচাই এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”