সাম্প্রদায়িক এবং নির্বাচনী সহিংসতাসহ দেশজুড়ে হত্যা, গুম এবং নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিদায়ী বছরকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘চরমতম বছর’ বলছে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক।
Published : 31 Dec 2021, 10:35 PM
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং নিজস্ব কিছু অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এসব ঘটনা তুলে ধরে বছরের শেষ দিন শুক্রবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ‘সঙ্কুচিত হয়েছে’ ২০২১ সালে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ২০২১ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসক মহাসচিব নূর খান বলেন, “যতটা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের আছে, সেই সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। এ যাবৎকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরমতম বছর এটি, এটাকে বর্বরতাও বলতে পারেন।”
আসক কর্মকর্তা অনির্বাণ সাহা লিখিত বক্তব্যে বলেন, চলতি বছর ৮০টি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার’ হিসাব এসেছে তাদের প্রতিবেদনে। মহামারীর কারণে লকডাউনের মধ্যেও ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হতাকাণ্ড’ ঘটেছে।
“সরকারেরে একাধিক মন্ত্রী জনপরিসরে ক্রসফায়ারের পক্ষে কথা বলেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন। যা প্রকৃতপক্ষে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকেই সমর্থন দেয়।”
আসক মহাসচিব নূর খান বলেন, “ক্রসফায়ার নিয়ে যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন সেই সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের বক্তব্য একদম দাড়ি-কমাসহ হুবহু একই রকম। ক্ষমতা থেকে সরে গেলে অবশ্য তাদের বক্তব্য উল্টে যায়।”
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে এক হাজার ১৩৪টি। এই আইনের মামলায় কারাবন্দি অবস্থায় চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান।
সাংবাদিক ‘নির্যাতনের’ নানা ঘটনাও চলতি বছর আলোচনায় ছিল জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘হামলা, মামলা, হুমকিসহ’ নানাভাবে ২১০ জন সাংবাদিক ‘নির্যাতনের শিকার’ হয়েছেন।
এর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মোজাক্কির। এছাড়া ১৭ মে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঁচঘণ্টা আটকে রেখে ‘হেনস্থা করা’ এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মামলায় জেলে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়।
নূর খান বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরকারীদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত। আর এর আসামিরা হচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ নানা পর্যায়ের মানুষ।”
‘উদ্বেগজনক’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের প্রতিবেদন তুলে ধরে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরাম (এমএসএফ)।
সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুলতানা কামাল লিখিত বক্তব্যে দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘লক্ষণীয়ভাবে উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেন।
“বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২১ সময়কালে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে।”
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফোরামের প্রতিবেদনে চলতি বছর বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে ‘অন্তত ২২ জনের মৃত্যুর’ তথ্য দিয়ে বলা হয়, “সেটা শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিতই ছিল না, বরং অনাকাঙ্ক্ষিতও ছিল।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ সমাবেশ ও হরতাল ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে দফায় সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার তথ্যও এ প্রতিবেদনে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৭ এপ্রিল বাঁশখালী তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে সাতজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এবং অন্তত ৩২ জন শ্রমিক গুরুতর আহত হন।
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হয়ে বিক্ষোভে নেমেও লোকজন পুলিশের মার খেয়েছে জানিয়ে বলা হয়, ই-অরেঞ্জ গ্রাহকরা টাকা ফেরত অথবা অর্ডার করা পণ্য ডেলিভারির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
এসব ঘটনায় পুলিশ ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বল প্রয়োগ না করে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পারত বলে মনে করে এমএসএফ ।
সংস্থাটি বলছে, জানুয়ারি থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতার ১৬৭টি ঘটনায় কমপক্ষে ৯১ জন নিহত, ১০০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৮১৫ জনের বেশি মানুষ।
নিহত ৯১ জনের মধ্যে ২১ জন প্রতিপক্ষের গুলিতে এবং ছয়জন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছেন। এদের প্রায় সকলেই ভোটে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সমর্থক বা কর্মী বলে তথ্য দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।
সেখানে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে নভেম্বর মাসের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে, যার সংখ্যা ৪৯। আর এ মাসেই নরসিংদী জেলায় নিহত হয়েছেন ১১ জন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “২০২১ সালে অক্টোবর মাসে সবচাইতে উদ্বেগজনক যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো- দূর্গাপূজা পালনকালে হিন্দুদের উপর সুপরিকল্পিত ও নিরবচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।”
দেশের ১৯টি জেলার পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ৫৩টি ঘটনা ঘটেছে, ৪১টি ঘরবাড়ি ও বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে।
১৩ থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নয়জন নিহত এবং কমপক্ষে দুইশতাধিক আহত হয়েছেন। গুরুতর আহতরা এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলেও লিখিত বক্তব্যে জানান সুলতানা কামাল।
নিহত নয়জনের মধ্যে ছয়জন মুসলমান এবং তিনজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।