মহামারীকালে আরেকটি ঈদ

করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, বিধি-নিষেধ তুলে দিয়ে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ করে দিল সরকার; তাতে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা মাথায় নিয়ে আরেকটি ঈদ এল বাংলাদেশে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2021, 06:31 PM
Updated : 21 July 2021, 04:31 AM

ঈদ আনন্দের বার্তা নিয়ে এলেও বুধবার ঈদুল আজহার দিন সেই খুশি আসবে না সবার ঘরে। অন্তত মঙ্গলবারও যে ২০০ জন কোভিড-১৯ রোগী মারা গেছে, তাদের পরিবারে। যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তাদের পরিবারে।

“কোরবানি তো দূরে থাক, ঈদ নিয়ে আমরা চিন্তাও করতেছি না,” বলছিলেন আরশাদুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী তার কোভিড-১৯ আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে রয়েছেন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।

এভাবে গত কিছু দিন ধরে প্রতিদিন দুই শতাধিক মৃত্যু আর ১১ হাজারের বেশি আক্রান্ত হওয়ায় ঈদের খুশিতে যেন স্বাস্থ্যবিধি না হারায়, সেই আহ্বানই আসছে বারবার। যদিও তা উপেক্ষিত দেখা গেছে ঈদের বাড়ি ফেরা এবং কোরবানির হাটের ভিড়ে।

ফলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে বিধি-নিষেধ থেকে মুক্তির সুযোগ যেভাবে মানুষ নিয়েছে, তাতে ঈদের পরে সংক্রমণ পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।

পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে- সে ইঙ্গিত দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, “আমার ভয় লাগে যে, ইন্দোনেশিয়া-ভারত এ পর্যায়ে না আমরা না পৌঁছাই। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ মৃত্যু হবে না- এটা বলা যাচ্ছে না। আমরা এটা বলতেও ভয় পাচ্ছি। কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই হবে।”

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ঈদের আগের দিন মঙ্গলবার ঢাকার আমিনবাজার সেতু এলাকায় মানুষের উপচেপড়া ভিড়ে হারিয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সরকার অবশ্য ঈদের দুদিন পর থেকে আবার কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। আর স্বাস্থ্যবিধি মানার মধ্য দিয়ে সেই লড়াইয়ে জেতার আশাবাদ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মহামারীর মধ্যে আগের তিনটি ঈদের মতো এই কোরবানির ঈদেও জাতীয় ঈদগাহে মুসল্লিদের পা পড়েননি। ঈদের নামাজ হয়েছে মসজিদে। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার কিংবা দিনাজপুরের গোর-ই শহীদ ময়দানেও এবার ঈদের জামাত হয়নি।

গতবারের মতো এবারও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে থাকছে তালা। আবার বৃষ্টির আভাসও রয়েছে, ফলে কোরবানির পশুর মাংস ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঝঞ্ঝাটের শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

আবার দেশে চামড়ার মোট চাহিদার প্রায় পুরোটা এই ঈদ থেকে আসে এলেও মহামারীর এই সময়ে পশু বিক্রি কম হওয়ার আভাসে চামড়া বাজারেও সুখবর না পাওয়ার শঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

টাঙ্গাইলের মিজানুর রহমান ঢাকার গাবতলী পশুর হাটে দুটি বড় ও দুটি ছোট গরু নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। ছোট গরু দুটি বিক্রি করতে পারলেও বড়গুলোর আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় ঈদের আগের দিন ট্রাকে করে ফেরত নিয়ে যান। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এই মহামারীর শুরুটা হয়েছিল গত বছর। ওই বছরের দুই ঈদের পর এবছর রোজার ঈদ যেভাবে কেটেছে, তার চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা চলছে এখন।

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে আক্রান্ত ও মৃত্যু হু হু করে বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির পরামর্শে ১ জুলাই থেকে লকডাউন জারি করেছিল সরকার।

দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধের পর ঈদ উদযাপনে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত সব বিধি-নিষেধ শিথিল করা হয়; যদিও তাতে স্পষ্ট আপত্তি ছিল কোভিড কারিগরি কমিটির। এতে পরিস্থিতি জটিল রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা জানায় তারা।

এরপর দেখা গেল দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর একের পর এক রেকর্ড। জুলাই মাসের অর্ধেক সময়েই যত মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছে, এর আগে কোনো মাসে এত মারা যায়নি। আক্রান্তের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই বুধবার কোরবানির ঈদের নামাজে শামিল হবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা; স্রস্টার কাছে প্রার্থনা জানাবে মহামারী মুক্তির। পশু কোরবানি দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পালন করবে।

আর এই আচার পালন করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধিতে যেন ঢিল না পড়ে, ঈদের শুভেচ্ছা বাণীতে সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, “এ বছর এমন একটা সময়ে ঈদুল আজহা উদ্‌যাপিত হচ্ছে যখন বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসের সংক্রমণে চরমভাবে বিপর্যস্ত। করোনার কারণে দেশের জনগণের জীবন ও জীবিকা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।”

তিনি বলেন, “জীবন বাঁচানো প্রথম অগ্রাধিকার হলেও জীবন বাঁচিয়ে রাখতে জীবিকার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। কঠিন এ সময়ে আমি দেশের আপামর জনগণের প্রতি কুরবানির মর্মার্থ অনুধাবন করে সংযম ও ত্যাগের মানসিকতায় উজ্জীবিত হয়ে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি।”

দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাতে তিনি বলেছেন, “গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা করোনাভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছি। আর এই লড়াইয়ে আমরা অনেক আপনজনদের হারিয়েছি। আজকে তাদের স্মরণ করছি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

“তবে এই লড়াইয়ে আমাদেরকে জিততেই হবে। এবং আমরা জিতব ইনশাল্লাহ।”

“করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন,” বলেছেন তিনি।

কোরবানির ‘ত্যাগের মহিমায়’ উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

নিজে সুস্থ থাকতে এবং সবাইকে সুস্থ রাখতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদুল আজহা উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও।

বায়তুল মোকাররম মার্কেটের টুপির দোকানে ৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা দামের টুপি পাওয়া যায়। তবে বিক্রি কম বলে হতাশ দোকানিরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বুধবার সকাল ৭টায় ঈদুল আজহার প্রধান জামাত হয়েছে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। এরপর সকাল ৮টা, সকাল ৯টা, ১০টা এবং বেলা পৌনে ১১টায় আরও চারটি জামাত হবে সেখানে।

বায়তুল মোকাররমের মতো ঢাকার অন্যান্য মসজিদেও এক বা একাধিক ঈদ জামাতের ব্যবস্থা থাকছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিবেচনায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারি করা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবাইকে অনুরোধ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পশু কোরবানির জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে কোরবানির পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে উভয় সিটি করপোরেশন।

ঈদুল আজহা ঘিরে নিরাপত্তা নিয়ে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।

ঈদের সময় ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন, “যারা ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়ি যাবেন, তারা ঘরের নিরাপত্তার জন্য দরজা জানালা ঠিকমতো লাগিয়ে যাবেন এবং মূল্যবান সামগ্রী স্বজনের বাসায় রেখে যাবেন।”

সবার সচেতনতার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “লাখ লাখ বাসায় নিরাপত্তা দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার।”

বিনোদন কেন্দ্র সব বন্ধ থাকলেও বরাবরের মতো ঈদে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা নিয়ে থাকছে টেলিভিশন স্টেশনগুলো। হাসপাতাল, কারাগার, শিশু সদনে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকছে।

ঈদের দিন চলাফেরায় কোনো বিধি-নিষেধ থাকছে না, তার পরদিনও নেই। ফলে বাইরে বের হতে মানা নেই। তবে সরকারি ঘোষণা না বদলালে তার পরদিন থেকে মহামারী নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে সবাইকে আবার ঢুকে যেতে হবে ঘরে, অন্তত এক সপ্তাহের জন্য।