“আগে আমরা যেমনটা পেরেছি, পেশেন্ট শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসলে আমরা চিকিৎসা করে ভালো করতে পেরেছি। এখন আগে আসলেও আমরা কিছু করতে পারছি না। কিছু কিছু জায়গায় মনে হচ্ছে আমরা ভাইরাসের কাছে হেরে যাচ্ছি,” হতাশ কণ্ঠে বলেন বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।
ডেল্টার সংক্রমণ নগর ছাড়িয়ে গ্রামে পৌঁছে যাওয়া এবং আক্রান্ত কম বয়সীদের মৃত্যু বেড়ে যাওয়া বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে চিকিৎকদের ভাষ্য।
গত বছরের এই সময়ের সঙ্গে এবারের পার্থক্য তুলে ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, গত বছরে সংক্রমণ শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে ছিল। এবার ঢাকার বাইরেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে ব্যাপক আকারে।
“একটা সময় আমরা বলতাম, বয়স্ক যাদের কোমর্বিডিটি বেশি, তারা মারা যাচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছি ইয়াংরাও মারা যাচ্ছে,” বলেন ডা. আহমেদুল কবীর।
ভারতে উদ্ভূত ডেল্টা ভ্যারয়েন্টের স্থানীয় সংক্রমণ ঘটায় গত এপ্রিলে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণ ও মৃত্যুর বিচারে গত এপ্রিলের পর ভয়াবহ মাস ছিল জুন। চলতি জুলাইয়ের অর্ধেক শেষ হতেই বোঝা যাচ্ছে, এটিই হতে যাচ্ছে ভয়াবহতম মাস।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জুন মাসে ৯৮ হাজার ৩৩০ জন এবং জুলাই মাসে ৯২ হাজার ১৭৮ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল।
এ বছর এপ্রিলে রেকর্ড ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭ জন, জুনে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
আর জুলাইয়ের ১৮ তারিখ পর্যন্তই ১ লাখ ৯০ হাজার ৭৩১ জন রোগী শনাক্তের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হচ্ছে সাড়ে ১০ হাজার জন।
একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রেও।
গত বছর জুনে ১ হাজার ১৯৭ জন এবং জুলাইয়ে ১ হাজার ২৬৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে ২ হাজার ৪০৪ জনের পর জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জনের মৃত্যু হয়।
মৃতের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতিতে জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই ৩ হাজার ৩৯১ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
এত আক্রান্ত ও মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ডেল্টা ধরনটি আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসায়ও রোগীকে সারিয়ে তোলা যাচ্ছে না।
“ভাইরাস সবার আগে ফুসফুসটাকে ড্যামেজ করে দিচ্ছে।”
এর আগে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যুই ছিল বেশি। এখনও তা বেশি হলেও সেই ব্যবধান কমে আসছে।
সোমবার দিনে যে রেকর্ড ২৩১ জনের মৃত্যু ঘটেছে, তার মধ্যে ৩৩ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪৩ জন। মৃতদের মধ্যে ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী সর্বাধিক ৭৪ জন।
এখন পর্যন্ত দেশে মোট মৃত ১৮ হাজার ১২৫ জনের মধ্যে এখনও সর্বাধিক ৫ হাজার ৬৬৯ জনের বয়স ৬১ থেকে ৭০ বছর।
আর ৫১-৬০ বছর বয়সী মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৪৮। ৪১-৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছে ২ হাজার ১৬৪ জন।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। মে মাসে দৈনিক শনাক্ত রোগী বাড়তে শুরু করে। সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী গ্রাফ শীর্ষে পৌঁছায় জুনের মাঝামাঝি।
গত বছরের ৭ জুন দৈনিক শনাক্ত রোগী ৩ হাজার ছাড়ায়। ২৯ জুন ৪ হাজার ১৯ জন শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পুরো জুলাই মাস জুড়ে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ থেকে তিন হাজারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
এই ধারা চলেছে অগাস্ট মাস পর্যন্ত। এরপর সংক্রমণ কমতে থাকে। গত বছরের নভেম্বরে এই ধারা কিছুটা বাড়লেও এ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ কমেছে।
এ বছর এপ্রিল মাস থেকে সংক্রমণ ফের বাড়তে শুরু করে। মে মাসে কিছুটা কমে জুনের প্রথম সপ্তাহে ফের সংক্রমণ বাড়তে থাকে।
ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, “এবারের করোনাভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল এবার সংক্রমণ বৃদ্ধি শুরুই হয়েছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে। যেসব জেলা সীমান্ত সংলগ্ন।
“গত বছর এই রোগ শুধু বয়স্কদের আক্রান্ত হলেও এ বছর ডেল্টায় কম বয়সীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।”
তিনি বলেন, গতবারের করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসক-নার্সরা চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে। ঢাকার এখন সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রস্তুত হলেও বাইরের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত না।
এ বছর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে তথ্য দিচ্ছে, সেখানে জেলাভিত্তিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। গত বছরের এ ধরনের তথ্য বিস্তারিত নেই। তবে বিভাগওয়ারি মৃতের সংখ্যা রয়েছে।
বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলাশহরগুলোয় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ।
গত বছর জুনে ঢাকা বিভাগে ৫৫২, চট্টগ্রামে ৩৩৫, রাজশাহীতে ৭৬, খুলনায় ৫৯, বরিশালে ৫২, রংপুরে ৩২, সিলেটে ৫৭ এবং ময়মনসিংহে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এ বছরে জুন মাসে ঢাকা বিভাগে মৃত্যু কমলেও (৪০৭ জন), চট্টগ্রামে বেড়ে হয়েছে ৩৪১ জন, রাজশাহীতে ৩৪৯ জন, খুলনায় ৪৭৭ জন, বরিশালে ৪১ জন, সিলেটে ৬৯, রংপুরে ১৪১ জন, ময়মনসিংহে ৫৯ জন।
গত বছরের জুলাই মাসের সঙ্গে এ বছরের জুলাই মাসের মৃত্যুর সংখ্যাগত পার্থক্য অনেক।
গত বছরের জুলাইয়ে মাসে ঢাকা বিভাগে ৪৯৮ জন, চট্টগ্রামে ২৮৩, রাজশাহীতে ৯৯, খুলনায় ১৫৫, বরিশালে ৬৩, রংপুরে ৬৯, সিলেটে ৭৭ এবং ময়মনসিংহে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এ বছর জুলাই মাসে ঢাকা বিভাগে গত বছরের দ্বিগুণের বেশি ১০১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে।
এছাড়া চট্টগ্রামে ৫০৬,রাজশাহীতে ৩৫৬, খুলনায় ৯৩৭, বরিশালে ১১১, সিলেটে ১০৭, রংপুরে ২৩৪ এবং ময়মনসিংহে ১২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।