জঙ্গিবাদে জড়িয়ে তরুণরা আবার আফগানমুখী

আশির দশকে যেভাবে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের ‘মুজাহিদ হতে’ আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গি হয়ে ফিরেছিল, চার দশক পর তেমনিভাবে আবার সেখানে যেতে তরুণদের ‘উসকানো’ হচ্ছে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2021, 04:29 AM
Updated : 11 May 2021, 04:29 AM

পুলিশের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের তিন তরুণ আফগানিস্তানে ‘হিজরত’ করতে বাড়ি ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনের সেখানে পৌঁছানোর বিষয়েও তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

এদের মধ্যে কুমিল্লার তরুণ আব্দুর রাজ্জাক ও সিলেটের শিব্বির আহমেদ আফগানিস্তানে পৌঁছেছেন বলে পুলিশের কাছে খবর রয়েছে।

রাজ্জাক সিলেটে একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাতেন। তার সন্ধান চেয়ে ভাই সালমান খান ২৫ মার্চ সিলেটের কোতয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।

আর রবিউল নামে নোয়াখালীর এক তরুণও আফগানিস্তানে পাড়ি জমাতে বাড়ি ছেড়েছেন বলে জানালেও তার অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ।

ওই দলের চারজনকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারাও আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ভাষ্য।

এই ইউনিটের উপ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চারজনের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।”

এদিকে উগ্র মতবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণদের নতুন করে আফগানমুখী হওয়ার পেছনে সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টির কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) এর ইনস্টিটিউট অব টেরোরিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আফগানিস্থান এখন একটি টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থাও খুবই নাজুক। এমন পরিস্থিতি শুধু সে দেশের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই অশনি সংকেত।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুযায়ী ১ মে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।

টুইন টাওয়ারে হামলার বার্ষিকী অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে যুক্তরাষ্ট্র।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামান রোববার সাংবাদিকদের বলেন, সম্প্রতি তারা একটি ‘মেসেঞ্জার গ্রুপের’ সন্ধান পেয়েছেন, যেটা জঙ্গিবাদী মতাদর্শ প্রচার ও কর্মকাণ্ড পরিচালনার একটি নেটওয়ার্ক।

“‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ নামের ওই চ্যাট গ্রুপে ১০ তরুণ যুক্ত ছিলেন। এদের মধ্যে দুজন আফগানিস্তান গেছেন, আরেকজনের বিষয়টি নিশ্চিত নয়।“

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, ওই তরুণেরা পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ ছেড়েছেন এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।

গত শনিবার যে চার তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারাও ‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ নামের ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত ছিলেন বলে আসাদুজ্জামান জানিয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার চারজন হলেন- রাজধানীর অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র জসিমুল ইসলাম জ্যাক (২৫), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানার মারকাজুস সুন্নাহ আল ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষক আব্দুল মুকিত (২৯), সিলেটের আল হিদায়া ইসলামিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আমিনুল হক (২০) এবং সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী সজীব ইখতিয়ার (২০)।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই তরুণরা বলেছেন, তাদের সহযোগীরা আফগানিস্তানে গেছেন ‘চট্টগ্রাম হয়ে’। আর সিলেট থেকে আব্দুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবার পাসপোর্ট প্রস্তুত করতে বলেছেন।

তবে এই আব্দুল্লাহ কে- সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেননি তদন্তকারীরা।

গ্রেপ্তার সজীব ইখতিয়ারের বরাত দিয়ে তদন্তকারীরা বলছেন, তার বন্ধু রাজ্জাক ঈদের আগেই তাকে আফগানিস্তানে নেওয়ার জন্য ‘পীড়াপীড়ি করছিলেন’। সিলেটের আব্দুল্লাহও তাকে চাপ দিচ্ছিলেন।

সিটিটিসির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ‘সায়েন্স প্রোজেক্ট’ গ্রুপটি গত বছরের অগাস্টে তৈরি করা হলেও গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে পরিচয় দুই বছরের বেশি সময় ধরে। গত দুই মাসের মধ্যে তাদের ‘আফগানযাত্রার প্রক্রিয়া’ শুরু হয়।

তারাও বাংলাদেশে ‘নাশকতা’ ঘটিয়ে আফগানিস্তানে ‘হিজরত’ করার পরিকল্পনায় ছিলেন জানিয়ে ডিআইজি আসাদুজ্জামান রোববার বলেন, “আপনারা জানেন, আনসার আল ইসলাম উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা বলে নিজেদেরকে দাবি করে। সেই সূত্র ধরেই তারা হয়ত বা আফগানিস্তানে হিজরত করতে গিয়ে থাকতে পারে। তবে এটা তাদের ভাষ্য। এ বিষয়ে আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারি নাই।”

আফগান থেকে আসা জঙ্গিবাদ

আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবা, যাদের একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক।

তাদের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও সেই আফগান ফেরত যোদ্ধাদের হাত ধরেই নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়।

আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বার্টিল লিন্টনার ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ে (পত্রিকাটির প্রকাশনা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে) ‘বাংলাদেশ: এ কোকুন অব টেরর’ নিবন্ধে লেখেন, পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের শাখা হিসেবে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। তালেবান নেতা ওসামা বিন লাদেন এদেশে হুজি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন।

হুজির প্রতিষ্ঠা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন, এ দেশে জঙ্গিবাদের উৎসমুখ বলে যাকে চিহ্নিত করা যায়, সেই হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) কার্যত ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

আফগান মুজাহিদদের কাবুল বিজয়ে উল্লসিত বাংলাদেশি ‘স্বেচ্ছাসেবী’দের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করেছিল সেদিন। সাংগঠনিকভাবে হুজি সংগঠিত হচ্ছিল ‘আরও কয়েক বছর আগে’ থেকে।

বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, হুজিই বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি কর্মকাণ্ড শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর হুজি প্রথম বোমা হামলা চালায় যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত হুজি দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে অন্তত ১০৬ জন নিহত ও সাত শতাধিক মানুষ আহত হন।

সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি। রাজধানীতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় ওই হামলায় ২২ জন নিহত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হুজির সব শীর্ষ নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুর দিকের সেই সময়ে জঙ্গিদের মধ্যে আফগানিস্তান যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। কারণ সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা নিজেদের মহলে উচ্চ মর্যাদা পেতেন।

গত এক দশকে ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানের পর শুরু হয় সিরিয়ায় যাওয়ার ধারা। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সিরিয়ায় গিয়ে কথিত জিহাদের অংশ নেন। তাদের কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও রয়েছে পুলিশের কাছে।

জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হুজি এখন আবার মাথাচাড়া দিতে চাইছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহাবুব আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হেফাজতে ইসলামের মানহাজি গ্রুপটির মধ্যে বেশ কয়েকজন আফগানফেরত ব্যক্তি রয়েছেন। তারা উগ্রপন্থায় আস্থা রাখেন। তাদের ইন্ধনেই মূলত চট্টগ্রাম অঞ্চলে সম্প্রতি সহিংসতা চালায় হেফাজত।

“ওই আফগানফেরত যোদ্ধাদের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) কয়েকজন সাবেক সদস্যও রয়েছেন। এরকম বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গত ৪ মার্চ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজির তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল। 

এরা হলেন- হুজির ‘অপারেশন শাখার প্রধান’ মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফ মিঠু ওরফে হাসান, সংগঠনের ‘শেখ’ সোহান শাদ ওরফে বারা আব্দুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবির।

এদের মধ্যে মাইনুল ঢাকায় মাদ্রাসা পরিচালনার নামে শিশুদের ‘জিহাদি’ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল বলে জানিয়েছে সিটিটিসি।

এছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক নাশকতায় আফগানফেরত যোদ্ধাদের ‘মদদ’ রয়েছে বলেও এরই মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।