বিবস্ত্র করে নির্যাতন: ‘দুর্বৃত্তদের দাপট রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়’

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা ও দায় পেয়েছে উচ্চ আদালতের গঠন করে দেওয়া অনুসন্ধান কমিটি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2020, 12:44 PM
Updated : 29 Oct 2020, 03:02 PM

নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এই অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দুর্বৃত্তরা সংগঠিত হয়ে এই ধরনের কাজ করছে।

অনুসন্ধান কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন, জেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা এবং চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের অধ্যক্ষ।

প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চে দাখিল করা হলে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক প্রতিবেদনের বেশ কিছু অংশ পড়ে শোনান।

এসময় আদালতে যুক্ত ছিলেন ঘটনাটি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ রাসেল চৌধুরী। বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন রেজা-ই রাকিব।

আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে অনুসন্ধান কমিটি।

“সে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ বা বাহিনী গড়ে উঠছে। এই বাহিনীগুলোর ক্ষমতার উৎসই হচ্ছে এই রাজনৈতিক ছত্রছায়া। এই গ্রুপ বা বাহিনীগুলো সমাজে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যকলাপ, অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। জীবনের স্বাভাবিকতা থেকে সরে এসে এরা চরম নৃশংস হয়ে উঠছে।”

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাসপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে ওই নারীর ঘরে ঢুকে তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছিল কয়েক যুবক।

এক মাস পর গত ৪ অ্ক্টোবর ওই নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এরপর ওই নারীকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নেয় স্থানীয় পুলিশ। তিনি তিনটি মামলা করলে মূল আসামিদের গ্রেপ্তারও করা হয়।

এই নির্যাতনকারীরা স্থানীয় ‘দেলোয়ার বাহিনীর লোক’ বলে তখনই জানিয়েছিল র‌্যাব। এই দেলোয়ার ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে এলাকায় দাপট নিয়ে চলতেন।

এই নির্যাতনের আগে দেলোয়ার তাকে ধর্ষণ করেছিলেন বলেও এখন অভিযোগ করেছেন ওই নারী। তিনি বলছেন, আগে তিনি এর প্রতিকার চাইতে সাহস পাননি।

আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাই কোর্ট কমিটির কাছে পাঁচটি বিষয় জানতে চেয়েছিল। ওই নারীর নিরাপত্তা, জবানবন্দি নেওয়া, দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের কোনো অবহেলা ছিল কি না?

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা ছিল। ওই নারী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের (মেম্বার) কাছে অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু ওই সদস্য তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

আর ওই সার্কেলের এএসপি ও বেগমগঞ্জ থানার ওসির বিষয়ে বলা হয়েছে, তাদের এ ঘটনা না জানার কোনো সুযোগ নেই।

“পুলিশের নিজস্ব সোর্স থাকে। সোর্স থাকার পরও কেন পুলিশ জানতে পারবে না, তা কমিটির বোধগম্য হয়নি। এটি পুলিশ প্রশাসনের অবহেলা বলেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে,” বলেন অ্যাডভোকেট মামুন।

মূল আসামি দেলোয়ার হোসেন

ভুক্তভোগী নারীর বাবার দায় নিয়ে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন তুলে ধরে এ আইনজীবী বলেন, “অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, ওই নারীর বাবা অনেক কিছুই জানতেন। কিন্তু দেলোয়ার বাহিনীর হুমকিতে ভয়ে তিনি কাউকে কিছু জানাননি। একারণে বাবার কোনো অবহেলা বা দায় খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।”

দাম্পত্য কলহের কারণে বাবার বাড়িতে থাকা ওই নারীর ওই নারীর স্বামীর ভূমিকাও উঠে এসেছে অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে।

মামুন বলেন, “স্বামীর বিষয়ে বলা হয়েছে, ওই নারীর সাথে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তার যোগাযোগ ছিল না। ঘটনার চার-পাঁচদিন আগে ওই নারীর সাথে তার যোগাযোগ হয়।

“প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেলোয়ার বাহিনীর সাথে তার (ওই নারীর স্বামীর) যোগাযোগ থাকার পরও সবকিছু জেনেও সে নিষ্ক্রিয় ছিল।”

ভিডিওর বিষয়ে অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, এটি করা হয়েছিল ওই নারীকে ‘অনৈতিক কার্যকলাপ’ এ য়ুক্ত প্রমাণ করার জন্য।

বিটিআরসির আইনজীবী রেজা-ই রাকিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্দেশমতো বিটিআরসি ওই ভিডিওটি ফেইসবুক, ইউটিউব থেকে অপসারণ করেছে এবং ভিডিওর একটি কপি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিষয়টি আদালতকে জানিয়েছি।”

অনুসন্ধান কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছে, নির্যাতনের এ ঘটনাটি নৃশংস, অমানবিক ও নারীত্বের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননাকর।

“বিষয়টি আকস্মিক নয়, পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছে, যাতে ওই নারী স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে না পারে। তাকে কেন্দ্র করে রহস্যজনক (মাদক ক্রয়-বিক্রয়) কর্মকাণ্ড বহাল রাখা যায়। তাছাড়া দেলোয়ারের যৌনসঙ্গী হিসেবে জিম্মি রাখার কৌশল হিসেবেও এ ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।

“ওই নারীকে মারধর করা, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ এবং যৌন নির্যাতন-নিপীড়ন করা ছিল সন্ত্রাসীদের এক ধরনের বিকৃত উল্লাস ও শক্তি প্রদর্শন। ভিডিও ধারণ ছিল মূলত ওই নারীকে জিম্মিকরণের একটা জঘন্য ও নৃশংস প্রক্রিয়া।”

দেলোয়ারকে এ ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে অনুসন্ধান কমিটি বলেছে, এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া উচিৎ, যাতে এ দেশে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে আর কখনও সাহস না পায়।

এ জন্য কমিটি প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও দিয়েছে উচ্চ আদালতে।

>> নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নারীর সম্ভ্রমহানির বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যসূচিতে বিষয়টির অমানবিক দিক, নৈতিক অধঃপতন তুলে ধরার পাশাপাশি আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ ও দ্রুত সময়ের মধ্যে সাজা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

>> সংঘবদ্ধ অপরাধ উচ্ছেদ বা নির্মূল করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে দেশের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী ব্যক্তির নামে গঠিত সন্ত্রাসী বাহিনীকে বিশেষ অর্ডিন্যান্স বা আইন পাসের মাধ্যমে নির্মূলের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে বিশেষ আদালতের অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

এ সুপারিশে অনুসন্ধান কমিটি একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছে, “আমরা মনে করি, ব্যক্তির নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন, পরিচালনা ও অপরাধ সংঘটন রাষ্ট্র ও নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা। নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে এ ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মূল করা এবং বিচারের মুখোমুখি করা সময়ের দাবি।

>> গ্রাম পুলিশ, বিট পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশিং নামে মাত্র চালু না করে এই ব্যবস্থাগুলো গতিশীল করতে হবে। এসব খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন।

জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগ ও রাষ্ট্রের নজরদারী আরও জোড়দার করতেও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।          

দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করা নির্যাতনের এ ঘটনা গত ৫ অক্টোবর নজরে আনার পর হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দিয়েছিল।

ভুক্তভোগী ওই নারীর অভিযোগ বা জবানবন্দি নেওয়া, নিরাপত্তা, দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো অবহেলা বা দায় আছে কি না তা অনুসন্ধান করে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

এছাড়া ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।

পাশাপাশি বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে ভিডিওটি পেনড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষণ করতে বলা হয়।

আর এ ঘটনায় দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় আদালত।

এছাড়া আদালত এ ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে আগামী ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছে। ২৯ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির দিন রাখা হয়েছে।

রুলে আদালত জানতে চেয়েছে, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ওই নারীকে রক্ষায় এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ থানার অন্যান্য কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না।

স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিআরটিসির চেয়ারম্যান, নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক, বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

নির্যাতনের শিকার ওই নারী বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং ধর্ষণের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেন।

তিন মামলায় ঘটনার হোতা দেলোয়ারকে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। বর্তমানে দেলোয়ার মোট ৭টি মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

এছাড়া নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় মোট ১২ আসামি কারাগারে রয়েছেন; যার মধ্যে ৮ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।