ল্যাব বাড়লেও কমেছে নমুনা পরীক্ষা

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়লেও নমুনা পরীক্ষা উল্টো কমেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2020, 01:46 PM
Updated : 14 July 2020, 03:18 PM

জুনের শেষ দিন এবং জুলাইয়ের প্রথম দুদিন দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার থেকে ১৯ হাজারের মধ্যে। তাতে ওই তিন দিনে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ৩৬০০ থেকে ৪ হাজারের মধ্যে ছিল।

আর সর্বশেষ তিন দিনে সারা দেশে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১৩ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৬০০ থেকে ৩২০০ এর মধ্যে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পরীক্ষা করা নিয়ে মানুষের মধ্যে আর আগের মত ‘আগ্রহ নেই’। তাছাড়া আক্রান্তরা সুস্থ্য হলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষা এখন আর করা হচ্ছে না; এটাও পরীক্ষা কমার একটি কারণ।  

তাহলে কী ধরে নেওয়া যায় যে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলছেন, এই পরিসংখ্যানে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নেই।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলছেন, প্রকৃতপক্ষে সংক্রমণ এখনও বাড়ছে, কেননা প্রতিদিনের নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত রোগীর হার এখন আগের তুলনায় বেশি।

দেশে সংক্রমণের এই অবস্থায় করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তারা দুজনেই।

 

পরীক্ষা বাড়ার পর যেভাবে কমেছে

গতবছর ডিসেম্বরের শেষে চীনের উহানে নতুন এ করোনাভাইরানের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর তা চীনের বাইরেও ছড়াতে শুরু করে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা শুরু হয় ২১ জানুয়ারি। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মত তিনজনের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানানো হয় সরকারের তরফ থেকে। 

শুরুতে কেবল আইইডিসিআরেই করোনাভাইরাস শনাক্তের আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। মার্চ পর্যন্ত সময়ে ওই একটি ল্যাবেই এ পরীক্ষা হয়েছে।

রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় এরপর ল্যাবের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রথমে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সরকারি ল্যাবে এবং পরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের ল্যাবে এ পরীক্ষা শুরু হয়।

৩১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ল্যাবের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৮টি। এরপর ৩১ মের মধ্যে তা বেড়ে ৫২টি হয়।

পরের এক মাসে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ল্যাব বেড়ে হয় ৬৮টি। সর্বশেষ মঙ্গলবার ৭৯টি ল্যাবে এ পরীক্ষার কথা জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। 

কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য মিরপুরে সরকারী ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বসানো বুথে করোনাভাইরাস শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরকার নির্ধারিত ল্যাবরেটরিতে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত সময়ে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

এ পর্যন্ত দেশে মোট ৯ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টি নমুনা পরীক্ষার কথা জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এর মধ্যে ৩০ জুন সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৪২৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।

গত ২ জুলাই সারা দেশে ৭০টি ল্যাবে ১৮ হাজার ৩৬২টি নমুনা পরীক্ষা হয়। তাতে ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের কথা জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ।

এরপর ল্যাবের সংখ্যা বাড়লেও ওঠানামার মধ্য দিয়ে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমতে শুরু করে, সেই সঙ্গে কমে আসে শনাক্ত রোগীর সংখা। 

মঙ্গলবারের বুলেটিনে মোট ১৩ হাজার ৪৫৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩ হাজার ১৬৩ জনের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানানো হয়।

কেন কমছে?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নমুনা পরীক্ষা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারাও আলোচনা করছেন। তিনটি কারণে নমুনা পরীক্ষা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।

কারও আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ এলে তাকে কোভিড-১৯ রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী একজন রোগীর উপসর্গ সেরে যাওয়ার পর এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরও দুই দফা পরীক্ষা করে দেখা হত তার শরীরে ভাইরাস আছে কি না। পরপর দুটো পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলে তখন তাকে সুস্থ বিবেচনা করা হত। 

নাসিমা সুলতানা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন প্রটোকল অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা নমুনা পরীক্ষা থেকে তারা সরে এসেছেন। তাতে মোট পরীক্ষার মধ্যে আক্রান্ত রোগীদের পরীক্ষার সংখ্যা কমে গেছে। 

“ডব্লিউএইচও বলছে, কেউ সুস্থ্য হলে, লক্ষণ উপসর্গ না থাকলে তার আর কোনো পরীক্ষা লাগবে না। এটি এখন আর করা হচ্ছে না।”

আগে সরকারি ল্যাবে সরকারি খরচে রোগীদের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হলেও জুনের শেষে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে বুথ আর হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে ২০০ টাকা এবং বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। 

এ বিষয়টিও পরীক্ষা কমার পেছনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে মন্তব্য করে নাসিমা সুলতানা বলেন, “যখন ফি ছিল না, তখন যাদের প্রয়োজন নেই এমন অনেকেও পরীক্ষা করিয়েছেন। এমন হয়েছে এক বাড়ি থেকেই ৪০ জনের নমুনা আনতে হয়েছে। ফি নির্ধারণ করায় এখন আর অনেকে অহেতুক নমুনা পরীক্ষা করছেন না।”

এছাড়া মানুষ এখন কোভিড-১৯ কে আগের চেয়ে ‘সহজভাবে নিচ্ছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মানুষের মধ্যে এখন আর আতঙ্ক নাই। শুরুতে সাধারণ হাঁচিকাশি হলেও পরীক্ষা করাতো। এখন মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। এ কারণে পরীক্ষা কমে গেছে, এটা আমার ধারণা।”

‘ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা’

করোনাভাইরাসের পরীক্ষা কমার কারণ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না সরকারের এ দপ্তরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, নমুনা পরীক্ষা কমিয়ে দিলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই কমবে। এ কারণে ওই পরিসংখ্যান থেকে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাচ্ছে না। তাতে কোভিড-১৯ মোকাবেলার ব্যবস্থাপনাতেও সমস্যা তৈরি হবে।

“যারা আক্রান্ত, তাদের খুঁজে বের করতে না পারলে আইসোলেশনে আনা যাবে না। আইসোলেট করতে না পারলে নতুন রোগী হবে। আমাদের পূঞ্জিভুত রোগী বেড়ে যাবে।”

ডা. বে-নজীর বলেন, সামনে কোরবানির ঈদের সময় লোকজনের চলাচল বেড়ে যাবে। তাতে পুঞ্জিভূত রোগীরা আরও বেশি মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়াবে।

“এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। কৃত্রিমভাবে শনাক্ত রোগী কমিয়ে আনা হলে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”

করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার যে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ করেছে, তার সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট নন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য জানান, শুরু থেকেই তাদের পরামর্শ ছিল দৈনিক নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা অন্তত ২০ হাজারে নিয়ে যাওয়ার। আর পরীক্ষা হতে হবে সারাদেশে।

“এখন পদ্ধতিগত ত্রুটি আছে। এখন মানুষ নিজেরা এসে নমুনা দিয়ে যাচ্ছে। যদি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে গিয়ে অসুস্থ বা সন্দেহজনক ব্যক্তির নমুনা নিয়ে আসা হত, তাহলে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ত, শনাক্তও বাড়ত। এখন অনেকেই সর্দিকাশি নিয়ে বাড়িতে বসে আছেন। এ কারণে আমরা সঠিক চিত্রটা পাব না।”

ফি নির্ধারণের বিষয়টি যে পরীক্ষা কমাতে ভূমিকা রেখেছে, অধ্যাপক নজরুলও সে বিষয়ে একমত; তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘অহেতুক পরীক্ষা কমার’ যে যুক্তি দিয়েছে, তার সঙ্গে নন।

তিনি বলেন, নমুনা পরীক্ষার ফি নেওয়া শুরু হয়েছে ২ জুলাই থেকে। ৩ জুলাইয়ে দেখা যায় নমুনা পরীক্ষা কমে গেছে এক ধাক্কায় প্রায় চার হাজার।

“এতে বোঝা যায় টাকার সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। ২০০ টাকা নিয়ে নমুনা পরীক্ষা করার চিন্তা কিভাবে এল, বুঝতে পারছি না। একটা লোক, যে আর্থিক কষ্টে আছে, সে তো টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে আসবে না।”

এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যার সঙ্গে শনাক্তের সংখ্যা কমতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংক্রমণের হার বাড়ছে।”

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ১২ জুলাই নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত ছিল ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ১১ জুলাই ছিল ২৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ১৩ জুলাই তা হয়েছে ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

“তার মানে সংক্রমণের হার বাড়ছে। এটাকে কোনোভাবেই কমছে বলা যাবে না। সংক্রমণের হার বাড়লে আমাদের আরও ভালো করে তথ্য দরকার। এজন্য নমুনা সংগ্রহ বাড়াতে হবে।”

জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির এই সদস্য বলেন, নমুনা পরীক্ষায় টাকা নেওয়া, সুস্থ্য হওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষা না করার সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হল তা তারা জানেন না।

“এই সিদ্ধান্তগুলো কেন নেওয়া হয়েছে, কাকে বলে নেওয়া হয়েছে, কার সঙ্গে যুক্তি করে নিয়েছে জানি না। কিন্তু ডিজি অফিস নিয়েছে। এর ফল আমাদের ভোগ করতে হবে।”