কোভিড-১৯ হাসপাতালে ৭০ শতাংশ শয্যাই খালি

রোগী দিন দিনই বাড়ছে বলে সরকার কোভিড-১৯ চিকিৎসার হাসপাতালও বাড়িয়েছে, কিন্তু ওই সব হাসপাতালের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শয্যাই এখন খালি পড়ে আছে।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2020, 05:19 AM
Updated : 13 July 2020, 11:18 AM

রোগীর সংখ্যার সঙ্গে মৃতের সংখ্যাও যখন বেড়ে চলছে, তখন হাসপাতালে শয্যা খালি কেন- জানতে চাইলে হাসপাতালগুলোর কর্তারা বলছেন, এখন রোগীদের মধ্যে রোগের তীব্রতা কম বলে তারা বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, হাসপাতালে আসতে হচ্ছে না।

তবে রোগীদের অনেকেই বলছেন, অব্যবস্থাপনার নানা খবর দেখে ও শুনে হাসপাতালে গিয়ে দুর্ভোগ পোহানোর আশঙ্কায় তারা ওমুখো হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, করোনাভাইরাস প্রকোপের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা রোগীদের হাসপাতালে যেতে অনাগ্রহী করে তুলেছে।

এদিকে গুরুতর রোগীদেরও হাসপাতালে না যাওয়ার প্রবণতা তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।

বিশ্বে মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে ঘটার পর মৃদু লক্ষণ –উপসর্গ দেখা দিলেই রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতে উদগ্রীব হয়ে যেতেন। শুরুতে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।

ফাইল ছবি

পরে রোগীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলে দুটি হাসপাতালে রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। একে একে রাজধানীর ১৬টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।

চট্টগ্রামেও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে আটটি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের সব সরকারি হাসপাতালকে নন-কোভিড রোগীদের পাশাপাশি কোভিড-১৯ রোগীদের সেবার জন্য আলাদা ইউনিট খুলতে নির্দেশনাও দেয়।

শনাক্ত রোগীর সংখ্যা যখন প্রায় ২ লাখ ছুঁইছুই, তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে কোভিড হাসপাতালগুলোতে যে শয্যা সংখ্যা রয়েছে, তার ৭০ দশমিক ৯৯ শতাংশই খালি পড়ে থাকছে। এক সময় আইসিইউর জন্য কোভিড-১৯ রোগীদের হাহাকার চললেও এখন সেখানেও শয্যা খালি থাকছে ৪৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ‘ডেডিকেটেড’ হাসপাতালে ১৪ হাজার ৬৬৮টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ৪ হাজার ২৫৪ জন, খালি পড়ে আছে ১০ হাজার ৪১টি শয্যা।

অন্যদিকে ৩৭৪টি আইসিউ শয্যার বিপরীতে ২১০ জন রোগী ভর্তি আছেন, খালি পড়ে আছে ১৬৪টি।

রোগীদের অনীহা

ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা তারেক আজিজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন গত মে মাসে।

লক্ষণ-উপসর্গ বিবেচনা করে তিনি শুরুতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করলেও পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত বদলান তিনি।

তারেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই মুহূর্তের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি ভীত ছিলাম।

হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রতিদিন গণমাধ্যমে এসেছে। চিকিৎসক যারা চিকিৎসা দেবেন, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীও ছিল না।

“হাসপাতালে ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৭-৮ জন রোগী মারা যাচ্ছেন। তাদের লাশ সরানোর জন্য পর্যন্ত কেউ থাকছে না। এমন অবস্থায় আমি বাসাতেই চিকিৎসা শুরু করলাম নিজের। দ্বিতীয় নমুনা পরীক্ষায় রেজাল্ট নেগেটিভ আসে।”

ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর মিরপুরের বাসিন্দা রিয়াজুল হকও সেই পথই অনুসরণ করেছেন।

তিনি বলেন, “আসলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। শ্বাসকষ্টের মতো তীব্র উপসর্গ ছিল না। নিয়মিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে যোগাযোগ রেখেছিলাম। তারাও যোগাযোগ করে খোঁজ নিত। বাসাতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে গেছি।”

সিলেটের ষাটোর্ধ্ব রোগী সুলতানা জামানের ছেলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, “মায়ের নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা... মা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট নিতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এরপর আর কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সাহস আমরা করিনি।

“হাসপাতালে যা অবস্থা... ডাক্তার আসে না... ওয়ার্ড বয়, নার্সরা এগিয়ে আসে না... এভাবে তো মাকে হাসপাতালে ফেলে রাখতে পারব না।”

চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় রেখেই মায়ের চিকিৎসা দিচ্ছেন জানিয়ে আশরাফুল বলেন, “বাসায় তাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছি। মা এখন অনেকটাই সুস্থতার পথে। করোনাভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ তার মধ্যে যা ছিল, তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে।”

হাসপাতালে অনাস্থা?

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রোগীদের অনাস্থার জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থাপনাও দায়ী।

“জটিল রোগীরাই তো হাসপাতালে যান। তারা সেখানে গিয়ে ঠিকমত চিকিৎসা পান না। স্বাস্থ্যকর্মীরা তার পাশে যান না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।”

হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরতের ঘটনায় প্রান্তিক মানুষের মনে আস্থা কমতে শুরু করেছে বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।

“করোনাভাইরাসে শুরুতেই হাসপাতালগুলো নানা অজুহাতে রোগী ফেরানোর ঘটনাতেই এখন রোগীর সংখ্যা কমেছে হাসপাতালে।

ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের এ সময়ে কিন্তু নন কোভিড রোগীরাও মারা গেছেন । তারা কেউ অন্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে গেল তাদের বলা হত, করোনাভাইরাসে টেস্ট করিয়ে নিয়ে আসুন। করোনাভাইরাসের টেস্টের নমুনা নিয়ে যা হল, সে তো দেখলাম!”

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন নিয়মিতভাবে হাসপাতালগুলোকে শয্যা খালি থাকার পরিসংখ্যান তুলে ধরায় স্বাস্থ্য খাতে ‘স্বচ্ছতা এসেছে’ বলেও মন্তব্য করেন ডা. মুশতাক।

তিনি বলেন, “এখন সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারলে, কমপ্লিকেটেড রোগীরা হাসপাতালে আসতে ভরসা পাবেন।”

তীব্রতা কমছে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) রফিকুল আলম বলছেন, করোনাভাইরাসের বেশিরভাগ রোগীর লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু থাকায় তারা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু রোগের তীব্রতা কিছুটা কমছে। আগের মতো লক্ষণ-উপসর্গ বেশি থাকা রোগীর সংখ্যা কমে আসছে। তারা বাসাতেই চিকিৎসা নিতে নিরাপদ বোধ করছেন। মৃদু উপসর্গ থাকলে হাসপাতালে আসার তো কোনো প্রয়োজন নেই।”

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিলুর রেজা বলেন, “শুরুর দিকে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, এসব কিছু শুরু হলেই রোগী হাসপাতালে ছুটে আসতেন। তখন আমাদের ১৩০ থেকে ১৪০ শতাংশ রোগীও ভর্তি করতে হয়েছে। কিন্তু সে পরিস্থিতি এখন নেই।

“হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো অ্যাড হয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোতেও কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি করানো হচ্ছে। সে কারণেও রোগীর সংখ্যা কম। যাদের মৃদু উপসর্গ থাকছে, তারা বাসাতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হচ্ছেন।”

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস আক্রমণের শুরুতে যে হারে জটিলতা ছিল, তা এখন কমতে শুরু করেছে। তাই হয়ত রোগীর সংখ্যা কম।”

তবে গুরুতর রোগীদের বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকির দিক দেখিয়ে বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য ডা. রফিকুল বলেন, “যেসব রোগীর লক্ষণ-উপসর্গ প্রবল মাত্রায় রয়েছে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

“অনেক রোগীর পরিবার বাসাতেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে তাদের অক্সিজেন দিচ্ছেন। এতে বিপরীতটাও হতে পারে। স্যাচুরেশন লেভেল অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে। তাদের হাসপাতালে আসতেই হবে।”

ঢাকা মহানগরীতে ‘কোভিড ডেডিকেটেড’ হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যার তথ্য (১১ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত)

 

হাসপাতালের নাম

জেনারেল

শয্যা

জেনারেল

শয্যায়

ভর্তি রোগী

জেনারেল

শয্যা

খালি

আইসিইউ

শয্যা

আইসিইউ

শয্যায়

ভর্তি রোগী

আইসিইউ

শয্যা

খালি

কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারী হাসপাতাল, উত্তরা, ঢাকা।

২০০

১৪৩

৫৭

১৬

১৬

৫০০ শয্যা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল

২৭৫

২৪১

৩৪

১০

১০

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ইউনিট-২) ও বার্ণ ইউনিট

৮৮৩

৫৯৩

২৯০

২৪

১৬

৫০০ শয্যা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।

৩০৬

১০৪

২০২

১০

১০

রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, ঢাকা।

১০১২

৪০৬

৬০৬

১৫

১৪

বি এস এম এম ইউ, ঢাকা।

৩৭০

১০৮

২৬২

১৫

১০

ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, বাবু বাজার, ঢাকা।

১০৫

২৫

৮০

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।

১০

লালকুঠি হাসপাতাল, মিরপুর, ঢাকা।

১২১

৪০

৮১

১০

রেলওয়ে হাসপাতাল, কমলাপুর, ঢাকা।

৩০

৩০

১১

২৫০ শয্যা শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।

১৪০

৩১

১০৯

১৩

১২

হলি ফ্যামিলী রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

৪২০

১৩৭

২৮৩

১০

১০

১৩

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।

২০০

৭৯

১২১

১০

১০

১৪

 

২০১৩

৪৫

১৯৬৮

১৫

বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতাল, কুড়িল, ঢাকা।

৪৬

৪০

১৬

সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল, ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।

১৭৪

১৪৪

৩০

মোট

 

৬৩০৫

৬৩০৫

২১০৩

২৪৫

১৪২

১০৩

 তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

চট্টগ্রাম মহানগরীতে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিইউ শয্যার তথ্য (১১ জুলাই দুপুর ১২টা পর্যন্ত)

 

হাসপাতালের নাম

জেনারেল

শয্যা

জেনারেল

শয্যায়

ভর্তি রোগী

জেনারেল

শয্যা

খালি

আছে

আইসিইউ

শয্যা

আইসিইউ

শয্যায়

ভর্তি রোগী

আইসিইউ

শয্যা

খালি

আছে

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

১৬০

১৫১

১০

বিআইটিআইটি, ফৌজদারহাট, চট্টগ্রাম

৩২

১৭

১৫

২৫০শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

১৫০

৯৯

৫১

১০

হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

১০০

৯৩

১০

চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

১০০

৯৭

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম

২৮

২২

বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতাল, পাহাড়তলী,চট্টগ্রাম

৪৭

৪০

ফিল্ড হাসপাতাল, ভাটিয়ারী, চট্টগ্রাম

৪০

৩৩

মোট

 

৬৫৭

৩১৩

৩৪৪

৩৯

২০

১৯

তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর