আদালতের এখতিয়ার নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ প্রশ্ন তোলার পর সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যায় সন্দেহভাজন মো. তানভীর রহমানের ক্ষেত্রে মামলা বাতিল চেয়ে করা আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 04 Mar 2020, 01:28 PM
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার আদালত এ আদেশ দেয়।
আদেশের আগে তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা (তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন) এবং এ হত্যাকাণ্ডে তানভীর রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়ে র্যাবের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
আদালতকে তিনি বলেন, “এ মামলার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা ও সন্দেহভাজন মো. তানভীর রহমানের সম্পৃক্ততা নিয়ে জানতে গত বছরের ১৪ নভেম্বর আদেশ দিয়েছিল আদালত। সে অনুযায়ী প্রতিবেদনটি এসেছে, যা উপস্থাপন করা হল।”
এ সময় তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনের আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করে বেঞ্চ।
গত ১৪ নভেম্বর আদেশের সময় এই আদালতের এখতিয়ার ছিল ফৌজদারী মামলার। এরপর এখতিয়ার বদল হয়েছে আদালতের। এখন এই আদালতের এখতিয়ার রিট মামলার।
এই যুক্তিতে আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলে রাষ্ট্রপক্ষ।
তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম অপরপক্ষের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজের কাছে আদালতের এখতিয়ারে বিষয়ে জানতে চান।
তখন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ কার্যতালিকায় থাকা বেঞ্চটি দেখিয়ে বলেন, “মামলাটির শুনানি ও আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ আদালতের এখতিয়ার আছে।”
এরপর বেঞ্চের দুই বিচারক নিজেদের মধ্যে কিছু সময় পরামর্শ করে মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ দিতে গেলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে বলেন, “মামলাটি আপনারা শুনতে পারেন।”
কিন্তু আদালত তার কথায় কর্ণপাত না করে আদেশ দেয়।
“যেহেতু অত্র রুলটি চলমান সেহেতু আমাদের বিবেচনায় এই মামলার শুনানিতে এখতিয়ারগত কোনো বাধা নেই। তারপরও যেহেতু রাষ্ট্র আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেহেতু আমরা এ মামলার বিষয়ে কোনো আদেশ না দিয়ে তা কার্যতালিকা থেকে বাদ দিলাম।”
আদেশের পর মো. তানভীর রহমানের আইনজীবী আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, “এখতিয়ার থাকার পরও রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তিতে আদালত মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করব এই আদালতেই মামলাটির শুনানির জন্য।”
মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাসায় খুন হন।
থানা পুলিশ ও ডিবির হাত ঘুরে ঘটনার দুই মাস পর র্যাব তদন্তের দায়িত্ব পায়। এরপর দফায় দফায় সময় নিয়েও প্রতিবেদন দিতে পারেনি।
এর মধ্যে তানভীর উচ্চ আদালতে মামলা বাতিলে আবেদন করলে তার শুনানিতে র্যাবের তদন্ত নিয়ে গত বছর ১১ নভেম্বর হতাশা প্রকাশ করেন বিচারকরা।
পরে ১৪ নভেম্বর আদেশে হাই কোর্ট তানভীরকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দেয়।
পাশাপাশি মামলাটির তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা ও তানভীরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে আদেশের জন্য রাখে।
আদালতের উষ্মা
মামলার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার উপস্থাপন করার পর আদালত উষ্মা প্রকাশ করে, কিভাবে প্রতিবেদনটি আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হল, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে।
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার বলেন, “বিষয়টি কনটেমচ্যুয়াস (আদালত অবমাননাকর)। আমি সাংবাদিক ছিলাম, আমি কাউকে কোনো রিপোর্ট দেইনি। যে কারণে আমার সাংবাদিক বন্ধুদের অনেকেই আমাকে দেখতে পারেন না।”
এ পর্যায়ে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “সাংবাদিকদের কাজই হল খবরের পেছনে ছোটা। তারা খবর সংগ্রহ করতে ছুটবেই। আমরা তো সাংবাদিকদের কোনো দোষ দেখছি না। কিন্তু তাদের দেয় কে? হয় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কেউ দিয়েছে, নয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে। এই দুই দিকের একদিক থেকেই এগুলো মিডিয়ায় আগে চলে যায়। এগুলো ঠিক না।”
অমিত তালুকদার আবার বলেন, এভাবে রিপোর্ট প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল।
বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, “সাংবাদিকরা রিপোর্ট পেলেই ছাপাবে এটাই স্বাভাবিক। যদি আপনি ওই রিপোর্টের সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনের মিল না থাকে তখন তাদের দোষারোপ করতে পারেন বা তাদের ধরতে পারেন। রিপোর্ট আদালতে দাখিলের আগেই যে সাংবাদিকদের হাতে গেছে, দোষ তো কাউকে না কাউকে স্বীকার করতেই হবে।
“কোনো রিপোর্ট আসার আগেই যদি তা মিডিয়াতে চলে যায় সেটা দুঃখজনক। এটাতো ঠিক না। একেক মিডিয়ায় একেক ধরনের লেখা আসে। এতে বিচার্য বিষয়টির ওপর জনগণের এক এক ধরনের পারসেপশন তৈরি হয়।”
তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে গত সোমবার হাই কোর্ট, র্যাব ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। প্রায় সবকটি সংবাদ মাধ্যমই তাদের সংবাদে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনটি হুবহু প্রকাশ করে।
নতুন কিছু নেই অগ্রগতি প্রতিবেদনে
বুধবার উচ্চ আদালতে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে র্যাব, তাতে এই সাংবাদিক দম্পতির বাড়িতে অপরিচিত যে দুজনের ডিএনএ নমুনা পাওয়ার কথা জানিয়েছিল ২০১৭ সালে, ওই দুজনকে এখনও শনাক্ত করতে না পারার কথাই বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ডিএনএ পরীক্ষার প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী সাগরকে বাধার জন্য ব্যবহৃত চাদর এবং রুনির টি-শার্ট হতে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষণে প্রতীয়মান হয় উক্ত হত্যাকাণ্ডে কমপক্ষে দুইজন অপরিচিত পুরুষ জড়িত ছিল।
“এ অপরিচিত অপরাধী সনাক্তকল্পে ডিএনএ প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস ল্যাব ও পরাবন স্নেপশট ল্যাব কর্তৃপক্ষের সাথে বর্তমানে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ডিএনএর মাধ্যমে অপরাধীর ছবি/অবয়ব প্রস্তুতের চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে।”
আর হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন মো. তানভীর রহমানের মোবাইলের কল হিস্ট্রি তুলে ধরে তার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “হত্যাকাণ্ডের দিন অর্থাৎ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৮টায় সে (তানভীর রহমান) স্কুলের পিকনিকে অংশগ্রহণের নিমিত্তে পুবাইল চলে যান এবং রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় বাসায় ফিরে টেলিভিশনে রুনির হত্যার ঘটনা জানতে পারেন। মোবাইল কল লিস্ট অনুযায়ী হত্যার দিনে আনুমানিক সকাল ৭টা ২১ মিনিটে রুনির ফোন থেকে তানভীরের ফোনে কল যায়, যার স্থায়িত্ব ছিল ৮ সেকেন্ড।
“প্রতিদিন তানভীর ও রুনির মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগ হলেও হত্যার দিন তানভীর রুনিকে একবারও ফোন করেনি। এমনকি রাতে হত্যার খবর জানার পরও তানভীর রুনি বা সাগরের বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর নেননি বা তাদের জানাজাসহ কোনো ধরনের ধর্মীয় কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করেনি। স্বাভাবিকভাবে আসামি তানভীর রহমানের ঘটনার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আচরণ খুবই সন্দেহজনক। তাহাকে এই মামলার ঘটনায় জড়িত নহে এই কথা এ পর্যায়ে বলা যুক্তিযুক্ত হবে না।”
হত্যাকাণ্ডের পরদিন রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শেরেবাংলা নগর থানার এক কর্মকর্তা। পরে মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমের ওপর।
এর ৬২ দিন পর ডিবি ব্যর্থতা স্বীকার করে নিলে হাই কোর্টের আদেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার হাত ঘুরে এখন তদন্ত করছেন খন্দকার শফিকুল আলম।
সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নেন তিনি। সব মিলিয়ে ৭১ বার পিছিয়েছে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ।
আগামী ২৩ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ রয়েছে।