সংশোধনের জন্য রাজাকারের তালিকা স্থগিত

সরকার ঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য ওই তালিকা স্থগিত করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2019, 11:52 AM
Updated : 18 Dec 2019, 02:26 PM

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম আরিফ-উর-রহমান বুধবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “যাচাই-বাছাই করে নতুন করে এই তালিকা প্রকাশ করা হবে। কবে তা প্রকাশ করা হবে সেই সময় আমরা দিচ্ছি না। যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই এর পর নির্ভুলভাবে তালিকা প্রকাশ করা হবে।”

গত ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই তালিকা আপাতত মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, “তালিকাটি হুটহাট প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। যে তালিকা প্রচার হয়েছে তার সঙ্গে সচিবরে দপ্তরের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।”

বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ ওই তালিকা প্রকাশ করেন।

তিনি সেদিন বলেন, “একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, আমরা কোনো তালিকা তৈরি করছি না। যারা একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যেসব পুরোনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল সেটুকু প্রকাশ করছি।”

মন্ত্রী জানান, স্বাধীনতাবিরোধীদের এই প্রথম তালিকা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক রোববার তার মন্ত্রণালয়ে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের প্রথম তালিকা প্রকাশ করেন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এই তালিকায় বরিশাল, বরগুনা, রাজশাহী, বগুড়া ও ঝালকাঠি জেলার মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও একাত্তরের আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকজনের নাম আসায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ কর্মসূচিও দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধারা এসব ভুল দ্রুত সংশোধন করে নতুন তালিকা প্রকাশের দাবি জানান। আর এই ভুলের পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায় ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসা এই সংগঠনগুলোর নেতারা বলেন, দালাল আইনের আওয়তায় তালিকাভুক্ত রাজাকারদের গেজেট অনুসরণ করা হলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হত না। রাজাকারের এই তালিকা প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা ছিল জরুরি।

এই প্রেক্ষাপটে ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, একাত্তরে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না, এমন কারো নাম সরকারের প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় এসে থাকলে তা বাদ দেওয়া হবে।

তবে ভুলের দায় অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী বলেন, “এই তালিকাটি ১৯৭১ সালে করা। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করেছি।”

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা সরবরাহ করার সময় যেসব ব্যক্তির নাম-মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল, সে বিষয়ে ‘নোট’ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই সব ‘নোট’ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই নোটগুলো বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা আবার প্রকাশ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বুধবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই তালিকা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনের পর নতুন করে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন

এর কয়েক ঘণ্টা পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তালিকা স্থগিত করে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায়।

৯৯৬ জনের নাম ‘বাদ দিতে বলেছিল’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, স্বাধীনতার পর দালাল আইনে মামলা হওয়া আসামিদের তালিকা তার দপ্তর থেকে নোটসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেটা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা করে দেখা উচিৎ ছিল।

আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নোট বিবেচনায় না নিয়ে তড়িঘড়ি করে বিজয় দিবসের আগের দিন এই তালিকা প্রকাশ করতে গিয়েই ভুল থেকে গেছে।

ভুলের দায় কার- সেই প্রশ্নে আলোচনার মধ্যেই বুধবার এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী যখন তথ্য সহযোগিতা চেয়েছিলেন, তারা ‘স্পষ্ট করেই’ তাকে বলেছিলেন যে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের সম্পূর্ণ তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

“আমাদের কাছে রয়েছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ মধ্যে যারা নাকি… যাদের নামে দালাল আইনে যারা অভিযুক্ত হযেছিলেন কিংবা যাদের নামে মামলা হয়েছিল সেই তালিকা। ভুল করে হোক আর শত্রুতা করে হোক যাদের নামে মামলা হয়েছিল তাদের তালিকাও দিয়েছি। এই জায়গা নোটের ভেতরে ৯৯৬ জনের নাম আমরা দিয়ে দিয়েছি যেগুলো এই তালিকার আওতায় আসে না। তারা এই মামলার আসামি নয়।”

বিষয়টি স্পষ্ট করে কামাল বলেন, “যে ৯৯৬ জনের কথা বলছি, এখানে ভুল করে হোক কিংবা এখানে যেহেতু তাদের নামগুলো আসছে। সেগুলোর নাম মূল আসামি কিংবা বিবাদীর জায়গায় যাবে না। সেটি বাদ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। সেভাবে সংশোধন করেই পাঠিয়েছিলাম।”

ভুল তালিকার জন্য দায়ী কোন মন্ত্রণালয় সেই প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি স্পষ্ট করে বলছি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা, রাজাকারের তালিকা তৈরি করা এটার দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের, আমাদের নয়।”

রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম রাখার বিষয়টি কারো ইচ্ছাকৃত হলে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, হার্ডকপির পাশাপাশি পেনড্রাইভে করে তালিকাটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছিল।

যে তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছে, সেখানে করণিক ভুল থাকলে তা ঠিক করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দেওয়ার কথা বলেন আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

“৩০-৪০ বছর ধরে আমাদের এখানে তালিকাগুলো ছিল। কতগুলো কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে আসছে, এগুলোর পাঠোদ্ধার করে যে তালিকা করেছি সেখানে কোনো ভুল হয়েছে কি-না সেটা আমরা খতিয়ে দেখব। সেই জায়গাটিতে আমরা ভুল করেছি কি-না সেটা আমরা দেখব।”