ওসি মোয়াজ্জেমের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে ফেনী ও রংপুর পুলিশের ঠেলাঠেলি

আদালতের পরোয়ানা জারির দুই সপ্তাহ গড়াতে চললেও পুলিশ এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে।

লিটন হায়দার অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2019, 04:47 PM
Updated : 9 June 2019, 05:10 PM

সোনাগাজীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ানোয় অভিযোগবিদ্ধ এই ওসির পরোয়ানা তামিল নিয়ে ফেনী ও রংপুর পুলিশের মধ্যে চলছে ঠেলাঠেলি।

নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার বাদী তার বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারে পুলিশ যত গড়িমসি করবে, তাদের প্রতি মানুষের অনাস্থা ততই বাড়বে।”

নিজ বাহিনীর কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারে পুলিশ আন্তরিক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও।

এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, “যদি কেউ পলাতক হয়ে যায়, একটু সময় তো লাগবে তাকে খুঁজতে।”

গত মার্চ মাসে নুসরাত যখন তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন, তখন সোনাগাজী থানার ওসি ছিলেন মোয়াজ্জেম।

ওই মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার পর তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলা হয় ঢাকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। ওই মামলায় গত ২৭ মে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল এই পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে।

কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর সমালোচনার মুখে ওসি মোয়াজ্জেমকে সোনাগাজী থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় পুলিশের রংপুর রেঞ্জে। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়।

এখন আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল কে করবে, তা নিয়ে ফেনী পুলিশের সঙ্গে রংপুর পুলিশের চলছে ঠাণ্ডা লড়াই। ফলে পরোয়ানাটি ফেনী ও রংপুরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আর এরই মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম পালিয়ে গেছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে; যদিও পরোয়ানা জারির দুদিন পর আগাম জামিন চেয়ে হাই কোর্টে আইনজীবীর মাধ্যমে তার আবেদন জমা পড়ে।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের ওই পরোয়ানাটি চার দিন পর গত ৩১ মে ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছালেও জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান সাংবাদিকদের বারবার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকেন।

এক পর্যায়ে গত ৩ জুন তিনি পরোয়ানাটি হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে মোয়াজ্জেম এখন ফেনীতে নেই বলে ওই পরোয়ানাটি বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে রংপুর রেঞ্জে পাঠিয়ে দেয় ফেনী পুলিশ।

এখন আবার পুলিশের রংপুরের কর্মকর্তারা বলছেন, কাজটি বিধি মোতাবেক না হওয়ায় পরোয়ানাটি ফেনীতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুরের এক পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেনী পুলিশ যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আমাদের কাছে পাঠিয়েছে, তা নিয়মবহির্ভূত।”

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আদালত যে ঠিকানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে, সে ঠিকানায় আসামি না থাকলে কোন ঠিকানায় আছে, তা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর ওই থানার কাছে কাছে আসামি গ্রেপ্তারে সাহায্য চাইবে। সরাসরি আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশনামাটি পাঠাতে পারে না “

তাই ফেনী থেকে আসা ওই পরোয়ানা ফেনীতেই ফেরত পাঠানো হবে বলে জানান রংপুরের এই পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশের রংপুর রেঞ্জের প্রধান ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফেনী জেলা পুলিশ থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি শনিবার তাদের কাছে আসে।

মোয়াজ্জেমের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তিনি গত ২৭ মে থেকে নেই, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার মোবাইলও বন্ধ।”

ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছে পুলিশ

পরোয়ানা পাঠানো নিয়ে প্রশ্ন তুললেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুরের ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “মোয়াজ্জেমকে না পাওয়ায় তার বাসার ঠিকানায় চিঠি দিয়ে হাজির হওয়ার জন্য বলা হবে। এরপরেও যোগাযোগ না করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোমবার থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে।”

অন্যদিকে ফেনীর পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোয়াজ্জেম তাদের কাছে নেই বলে ‘নিয়ম মেনেই’ তারা পরোয়ানাটি রংপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

রোববার পর্যন্ত ওই পরোয়ানাটি রংপুরে ফেরত আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অগ্রগতি সোমবার নাগাদ জানা যাবে।

ঘটনাস্থল সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. মঈন উদ্দিন রোববার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরোয়ানাটি হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।

পরোয়ানাটি রংপুরে পাঠানো যথাযথ ছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যা হওয়ার হয়ে গেছে, এটা নিয়ে আর কথা না বলাই ভাল। আমরা এখন তাকে (মোয়াজ্জেম) খুঁজছি।”

মোয়াজ্জেমের গ্রামের বাড়ি যশোর সদরের চাচড়া গ্রামে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান সোনাগাজীর ওসি। 

এরপর যোগাযোগ করা হলে যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি অপূর্ব হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে তারা পদক্ষেপ নেবেন।

“শুনেছি তার (মোয়াজ্জেম) নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। সংশ্লিষ্ট থানা থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ব্যাপারে রিক্যুজিশন আসলে তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে।”

তবে ওসি মোয়াজ্জেমের গ্রামের বাড়িতে অবস্থানের কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রংপুরে থাকা ওসি মোয়াজ্জেম মে মাসের শেষ দিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে নিখোঁজ।

ওসি মোয়াজ্জেমকে পুলিশ গ্রেপ্তার না করে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি পুরো ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করেছে টিআইবি।

ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল আইনের মামলাটির বাদী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সাইয়েদুল হক সুমনও বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলাটির সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা নেননি।

“এখন যেহেতু পরোয়ানা ফেনী ও রংপুর দুই জায়গাতেই পৌঁছেছে বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। দেখা যাক তারা এখন কী করে?”

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেনী প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম]