বন্ধ হল বিজিএমইএ ভবন, এখন ভাঙার অপেক্ষা

এক যুগ ধরে রাজধানীর হাতিরঝিলের বুকে অবৈধভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিজিএমইএ ভবন অবশেষে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজউক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2019, 04:43 AM
Updated : 18 April 2019, 06:47 AM

এর অংশ হিসেবে ১৫ তলা এই ভবন খালি করে মঙ্গলবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালামাল ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভবনের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়ে রাজউক কর্মকর্তারা মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।

হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মালামাল সরিয়ে নেওয়ার পর আমরা সন্ধ্যা ৭টা থেকে বিভিন্ন ফ্লোরে তালা মেরে দিই। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিজিএমইএ ভবনের মূল ফটক সিলগালা করে দিই... এতে রাজউক এখন এ ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিল৷”

তিনি জানান, রাজউকের প্রকৌশলী দল বুধবার ভবনের নানা দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে ঠিক করবেন, কবে কীভাবে ভবনটি ভাঙা হবে।

সর্বোচ্চ আদালত বিজিএমইএ ভবন ভাঙার রায় দেওয়ার পর কয়েক দফায় সময় নিয়েছিলেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। সবশেষ আদালতের দেওয়া সাত মাস সময়সীমা গত ১২ এপ্রিল শেষ হয়।

ওই সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর মঙ্গলবার সকালে ভাঙার যন্ত্রপাতি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বিজিএমইএ ভবনের সামনে উপস্থিত হন রাজউকের কর্মকর্তারা।

রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) খন্দকার অলিউর রহমান সকাল সাড়ে ১০টায় ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “ভবন ভাঙার জন্য আমাদের বুলডোজারসহ অন্যান্য গাড়ি প্রস্তুত।

“তবে এই ভবনের বিভিন্ন তলায় ১৯টি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। আমরা আপাতত এসব প্রতিষ্ঠানের মালামাল সরিয়ে নিতে বলছি। এটা ভবন ভাঙার কাজেরই একটা অংশ।”

বিজিএমইএ ভবনে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখার পাশাপাশি নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল। রাজউক সময় বেঁধে দেওয়ার পর তারা মালামাল সরিয়ে নেওয়া শুরু করে।

প্রথমে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলেও পরে তা ৭টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সন্ধ্যার সময়ও ওই ভবন থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালামাল নিয়ে একের পর এক ট্রাক বের হতে দেখা যায়।

ভবন ভাঙার কাজ শুরু করার আগে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোনসহ সব ইউটিলিটি সার্ভিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন কর হবে বলে অলিউর রহমান জানান।

বিজিএমইএ ভবন ভাঙার আগে মঙ্গলবার সকালে সেখানে গিয়ে ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত মালামাল সরিয়ে নিতে বলেন রাজউক কর্মকর্তারা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভবন ভাঙতে ‘ডিনামাইট’

পনের তলা এই ভবন কীভাবে ভাঙা হবে- জানতে চাইলে রাজউক কর্মকর্তা অলিউর কিছু স্পষ্ট না করে বলেন, তারা আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করবেন।

“আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ভাঙা হবে। সেটা ডিনামাইট ব্যবহার বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে হতে পারে।”

এর আগে ঢাকায় বড় ভবন ভঙার একটি ঘটনাই ঘটেছিল; এক যুগ আগে তেজগাঁওয়ের সেই র‌্যাংগস টাওয়ার ভাঙার সময় দুর্ঘটনায় কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল।

ওই ঘটনা স্মরণ করে হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক রায়হানুল ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, এ ভবন ভাঙতে চীনা প্রকৌশলীদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।

“সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। তবে এখানে বেশ কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে, তেমনিভাবে ম্যানেজমেন্টের বিষয়ও আছে।”

রাজধানীর হাতিরঝিলে অবৈধভাবে নির্মিত বিজিএমইএ ভবন খালি করার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে রাজউকের পরিচালক খন্দকার অলিউর রহমান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ভবন ভাঙার জন্য আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর কেন পদক্ষেপ নেওয়া হল জানতে চাইলে রাজউক কর্মকর্তা অলিউর বলেন, “হাই কোর্ট ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। কিন্তু মাঝখানে কয়েকদিন বন্ধ ছিল, এরপর কর্মদিবস শুরু হয়েছে, আমরাও আমাদের কাজ শুরু করেছি।”

ভবন ভাঙার কাজ বন্ধ হওয়ার ‘কোনো সুযোগ নেই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হাতিরঝিলে অবৈধ ভবন ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করেছে রাজউক। এর অংশ হিসেবে ১৫ তলা এই ভবন খালি করার নির্দেশ দেওয়া হলে মঙ্গলবার ওই ভবনে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মালামাল ট্রাকে করে সরিয়ে নেয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

হাতিরঝিলের ‘ক্যান্সার’

জলাশয়ের উপর আড়াআড়িভাবে গড়ে ওঠা এই বিজিএমইএ ভবনকে হাতিরঝিলের প্রকল্পের ‘ক্যান্সার’ আখ্যায়িত করেছিল হাই কোর্ট।

এই ভবনের শুরুটা হয়েছিল দুই দশক আগে, ১৯৯৮ সালে। সরকারের কাছ থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে নিজেদের এই ভবন নির্মাণ শুরু করেছিলেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা, যার কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে।

তখন তাদের জলাশয় ভরাট করে ভবন তুলতে মানা করা হয়েছিল বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জানান। এই জমি দেওয়ার সময় তিনিই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন শুরুতেই অভিযোগ তুলেছিল, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে এবং উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করার মাধ্যমে ওই ভবন তোলা হয়েছে।

সংবাদপত্রে প্রতিবেদন নজরে আনা হলে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।

হাতিরঝিল প্রকল্পে গড়ে ওঠে বিজিএমইএ ভবন

রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ করা ওই জমি ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো যেভাবে বিজিএমইএকে দিয়েছে, তা ছিল বেআইনি।

ওই রায়ে এই ভবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে ‘একটি ক্যান্সার’ বলার পাশাপাশি হাই কোর্ট আরও বলে, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

“একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ আপিল করলে ২০১৬ সালের ২ জুন তাও খারিজ হয়ে যায়।

সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ হয়ে গেলে ভবনটি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না বিজিএমইএর।

তখন তারা ভবন থেকে কার্যক্রম সরিয়ে নিতে সময় চায় আদালতের কাছে। গত বছরের অগাস্টে সময় দেওয়ার সময় আদালত বিজিএমইএর কাছ থেকে মুচলেকা নিয়েছিল যে তারা আর সময় বাড়ানোর আবেদন করবে না।

হাতিরঝিলের ভবনটি রাখতে না পারার পর এখন ঢাকার উত্তরায় ১১০ কাঠা জমির উপর ১৩ তলা নতুন ভবন তৈরি করছে বিজিএমইএ; গত সপ্তাহে তা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।