বিজিএমইএ তা না করলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রেও ভবন ভাঙার টাকা তারা বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করবে।
প্রায় দুই দশক আগে নির্মিত ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে গত জুনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিল, মঙ্গলবার প্রকাশিত তার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে এসেছে এই নির্দেশনা।
হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) সাব্বির ফয়েজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।”
এই রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি বিজিএমইএ এবং রাজউকের কাছে পাঠানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রায়ের নির্দেশনা জানার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাসির জানান, তারা আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন।
“রায় প্রকাশের এক মাসের মধ্যে রিভিউ করার একটা অপশন আছে। আমরা অবশ্যই সে সুযোগটা নেব। এর পরে মহামান্য আদালত যে ডিসিশন দেবে আমাদের তো তা মেনে নিতেই হবে।”
নাসির বলেন, শেষ পর্যন্ত যদি ভবন ভেঙে ফেলতেই হয়, সেক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাত যে নির্বিঘ্নে চালিয়ে নেওয়া যায়, সেজন্য ‘ব্রিদিং স্পেস’ রাখার কথা রিভিউ আবেদনে বলা হবে।
এখন পর্যন্ত রায়ের কপি হাত পাননি জানিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলেন, রায় পড়ে দেখে তবেই তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চান।
এক সপ্তাহ আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, বিজিএমইএ ভবন ভাঙার খরচ কে দেবে- সেখানে রাজউকের দায়িত্ব কী হবে- তা নিশ্চিত হতে না পারায় তারা পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় আছেন।
আর গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, রায় পেলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে দেরি হবে না।
এ মামলায় হাই কোর্টের অ্যামিকাস কিউরির দায়িত্ব পালন করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আদালত ভেঙে ফেলতে বলেছে, বিজিএমই নিজেরাই যদি ভেঙে ফেলে তা তাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে। না হয় এটি তাদের ভাবমূর্তিতে একটি কালো দাগ হয়ে থেকে যাবে, যে বিজিএমইএর মত প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে একটি ভবন নির্মাণ করেছিল।”
তৈরি পোশাক খাতের শিল্পোদ্যোক্তাদের সমিতির এই ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ২ জুন হাই কোর্টের ওই রায়ই বহাল রাখে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সব দিক বিবেচনা করে হাই কোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো কারণ আপিল বিভাগ দেখছে না।
আইন ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় হাই কোর্ট বিভাগ যৌক্তিক রায় দিয়েছে জানিয়ে আপিল বিভাগ বলেছে, “আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, সংশ্লিষ্ট সব আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা বিজিএমইএ ভবন দাঁড়িয়ে থাকে পারে না। বরং অবিলম্বে ওই ভবন ভেঙে ফেলা উচিৎ।”
মামলার পূর্বাপর
>> ২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন।
>> প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
>> রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাই কোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়।
>> এতে স্থগিতাদেশ চেয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ এপ্রিল চেম্বার বিচারপতি হাই কোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়।
>> ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাই কোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে।
>> ২০১৬ সালের ২ জুন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর লিভ টু আপিল খারিজ করে দেয়।
তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরই বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৮ নভেম্বর শুরু হয় ভবন তৈরির কাজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিজিএমইএর ভবন উদ্বোধন করেন।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনিভাবে প্রদান করে। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না।
বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয় হাই কোর্টের রায়ে।
সেখানে বলা হয়, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনি। কারণ, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না।
“তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিৎ ছিল যে, এ জমির উপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়।”
রাজউক বলে আসছিল, ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা অনুযায়ী করা হয়নি। আর পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, “একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”