বিজিএমইএ ভবন: ‘অজুহাত’ নিয়ে বসে আছে রাজউক

ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত রায় আসার পর পাঁচ মাস হতে চললেও এ ব‌্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2016, 04:52 AM
Updated : 8 Nov 2016, 11:05 AM

রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি না পাওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। তবে তাদের এই যুক্তি গ্রহণযোগ‌্য বলে মনে করছেন না এ মামলায় হাই কোর্টের অ্যামিকাস কিউরির দায়িত্ব পালন করা মনজিল মোরসেদ।

মানবাধিকার ও পরিবেশ আইন বিষয়ক মামলায় অভিজ্ঞ এই আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবন না ভাঙতে এটা একটা অজুহাত হতে পারে।”

প্রায় দুই দশক আগে জলাধারের ক্ষতি করে বেআইনিভাবে গড়ে তোলা হয় ১৬ তলা বিজিএমইএ ভবন। হাই কোর্ট ২০১১ সালে এক রায়ে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়, যা গত ২ জুন আপিল বিভাগের রায়েও বহাল থাকে।  

হাই কোর্ট রায়ে বলেছিল, “বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে।”

দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তাদের সমিতির এই ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে’ শক্তিশালী একটি মহলকে ‘আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে’ এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আদালতের রায় বাস্তবায়নে কী উদ‌্যোগ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিজিএমইএ ভবন ভাঙার খরচ কে দেবে- তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি তারা। অপেক্ষার এটিও একটি কারণ।  

“ভাঙার একটা খরচ আছে। সেটা রাজউক দেবে, নাকি বিজিএমইএ- সেটা আমরা এখনও জানি না। পূর্ণাঙ্গ রায় না পেলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। সেখানে রাজউকের কী অংশ আছে সেটাও আমাদের বুঝতে হবে। রায় না দেখে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।”

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও বলছেন, রায় পেলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে দেরি করা হবে না।

“আমরা একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছি। তিনি এ ব্যাপারে কাজ করছেন। এছাড়া আমি অ‌্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছি। রায়ের কপিটা পেলে আমরা সেটা (বিজিএমইএ ভবন) ডেমোলিশ করে দেব।”

তবে হিউম্যান রাইটস অ‌্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদ মনে করছেন, সরকারের এই অপেক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি না পেলেও ভবন ভাঙতে বাধা নেই।

এর ব‌্যাখ‌্যায় তিনি বলেন, বিজিএমইএ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল, কিন্তু আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দিয়েছে। ফলে হাই কোর্টের রায়ই বহাল রয়েছে। আর সেই রায়ের কপি কর্তৃপক্ষের কাছে আছে।  

“সে হিসাবে আমার দৃষ্টিতে এটা বিলম্বিত করার কোনো কারণ নাই। তারা এটা (ভবন ভাঙ্গার কাজ) করতে পারে। আপিল বিভাগের রায়টা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ আপিল বিভাগের রায়ে কোর্ট কিছুই বলে নাই। আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায়টা বহাল রেখেছে।”

এই আইনজীবী বলেন, পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে বিজিএমইএ আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রেও ভবন ভাঙার উদ‌্যোগ নিতে কোনো বাধা তিনি দেখেন না।   

“রিভিউ করলে তো আর জাজমেন্ট স্টে হবে না। আর স্টে না হলে তো এ ভবন ভাঙতে রা্জউকের আর কোনো বাধা নেই।”

তাছাড়া রিভিউয়ে রায় পাল্টানোর ইতিহাস খুবই বিরল বলে মন্তব‌্য করেন মনজিল মোরসেদ।    

বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন‌্য তারাও রায়ের কপির অপেক্ষায় আছেন।

“আইনের প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। রিভিউ খারিজ হলে রায়ে যা আছে তাই হবে।”

২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাই কোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্লোর বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

হাই কোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনি। কারণ, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না।

“তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিৎ ছিল যে, এ জমির উপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়।”

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে।

তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরই বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৮ নভেম্বর শুরু হয় ভবন তৈরির কাজ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিজিএমইএর ভবন উদ্বোধন করেন।

হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনিভাবে প্রদান করে। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না।

ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। আর পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলায় এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, “একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে।”