তাবলিগের দ্বন্দ্ব পেরিয়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরু

তাবলিগ জামাতের কোন্দল পেরিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2019, 05:36 AM
Updated : 17 Feb 2019, 06:32 AM

শুক্রবার ফজরের নামাজের পর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ব সম্মিলনের কার্যক্রম শুরু হয়।

ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানান, পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক উর্দু ভাষায় শূল বয়ান শুরু করেন। আর বাংলাদেশের নোয়াখলীর মাওলানা নূরুর রহমান তা বাংলায় তরজমা করে শোনান।

ইজতেমাস্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দুতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ২৪টি ভাষায় তা তরজমা করে শোনানো হচ্ছে। 

দুপুর দেড়টায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণে ইজতেমা ময়দানে হবে জুমার নামাজ। তাতে ইমামতি করবেন কাকলাইল মসজিদের মাওলানা মো. জোবায়ের।

দেশের ৬৪ জেলা থেকে ইজতেমায় যোগ দিতে আসা মানুষের থাকার জন্য পুরো ময়দানকে ৫০টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে নানা বয়সী মুসলমানদের টঙ্গীমুখী ঢল শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকেই।

শুক্রবার ছুটির দিনে গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ টঙ্গী আসছেন ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজ পড়ার জন্য। শুক্রবার সকাল থেকেই পায়ে হেঁটে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।

ঢাকা থেকে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক ‘ভিআইপি’ অতিথি শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে ইজতেমা ময়দানে আসবেন বলে আশা করছেন আয়োজকরা।

তবু বিভক্তি

বিশ্ব ইজতেমা হল ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নী মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংঘ তাবলিগ জামাতের বার্ষিক আন্তর্জাতিক সমাবেশ।  কয়েক লাখ লোকের জমায়েতের কারণে বিশ্ব ইজতেমাকে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্মিলন বলা হয়। 

ভারতের ইসলামি পণ্ডিত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু আরবি,ফার্সি ও উর্দু শব্দ এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডে পরিভাষা হিসেবে যুক্ত হয়েছে।

তাবলিগ শব্দের অর্থ প্রচার। স্বেচ্ছামূলক এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের প্রচার করা।  আর ইজতেমা হল ধর্ম প্রচারের জন্য সমবেত হওয়া।

ইসলামের প্রচার বা দাওয়াত বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে তাবলিগ জামাতের সদস্যরা ইজতেমায় মিলিত হন। সেখান থেকেই দাওয়াতি কাজে বেরিয়ে যান।

১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের কাছে নূহ মাদ্রাসায় তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা হয়, যেখানে অংশ নেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। আর বাংলাদেশে প্রথম ইজতেমা হয় ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে।

তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমার আয়োজন হয়। প্রতি বছর লোক বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বর্তমান ইজতেমা মাঠে শুরু হয় এই বার্ষিক সম্মিলন।

সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি পরে স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হলেও তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এবার তা পিছিয়ে যায়।

তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছের নাতি দিল্লির মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির হাতে থাকবে, না দেওবন্দ মাদ্রাসার মাওলানা জুবায়েরের ছেলে জুহাইরুল হাসানের অনুসারীরা এ সংঘের নেতৃত্ব দেবেন তা নিয়ে এই বিভক্তি।

গতবছর বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতে ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন সাদ। পরে সরকারে মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়।

এ বছর তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষ জানুয়ারির দু্টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিশ্ব ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে সেই উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। ইজতেমা মাঠে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুও হয়।

এরপর গত ২৪ জানুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে তাবলিগের দুই পক্ষের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এবারের ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। দুই পক্ষের মতের মিল না হওয়ায় আয়োজনেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়।

আগে তাবলিগ জামায়াতের মুরুব্বিরা ইজতেমার ব্যবস্থাপনায় থাকলেও এবার বিষয়টি দেখছে স্থানীয় প্রশাসন। দেশের ৬৪ জেলাকে ভাগ করে গত কয়েক বছর ধরে দুই ভাগে ইজতেমার আয়োজন হচ্ছিল। এবার একসঙ্গেই চার দিনের চার দিনের ইজতেমার আয়োজন হয়েছে।

তবে ইজতেমায় সেই বিভেদের রেশ থেকেই যাচ্ছে। শুক্র ও শনিবার চলছে দেওবন্দপন্থিদের ইজতেমা। রবি ও সোমবার হবে দিল্লির সাদপন্থীদের সম্মিলন। শনি ও সোমবার হবে দুইবার হবে আখেরি মোনাজাত।

নিরাপত্তা

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার সদস্যরা কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।

ইজতেমা মাঠের পরিস্থিতি নজরে রাখতে পুলিশ ও র‌্যাব কন্ট্রোল রুম ও ওয়াচ টাওয়ার বসিয়েছে। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে কন্ট্রেল রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি। এছাড়া আইনশৃংখলা বাহিনী সদস্যরা সাধারণ পোশাকে খিত্তায় খিত্তায় অবস্থান করছেন।

বিশ্ব ইজতেমায় মানুষের আসার সুবিধার্থে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যান চলাচলে নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।

১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা পর্যন্ত এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা পর্যন্ত আব্দুল্লাপুর থেকে ভোগড়া বাইপাস এবং মীরের বাজার থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত উভয়মুখী রাস্তায় সকল প্রকার যানবাহান চলাচল বন্ধ থাকবে।

টঙ্গী রেলওয়ে জংশনের মাস্টার হালিম উজ্জামান জানান, ইজতেমা উপলক্ষে ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকল ট্রেন এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি কিছু ট্রেন টঙ্গীতে যাত্রাবিরতি করবে। মোনাজাতের দিন ১১ জোড়া বিশেষ ট্রেনসহ ইজতেমায় ১২০টি ট্রেন টঙ্গীতে যাত্রাবিরতি করবে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন, হামদর্দ, ইবনে সিনা, ইসলামিক মিশন, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হাফেজি হুজুর সেবা সংস্থা, হোমিওপ্যাথিক ওয়েলফেয়ার, বাংলাদেশ ইউনানি-আয়ুর্বেদিক, বঙ্গবন্ধু ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পসহ বেশ কিছু সংগঠন ইজতেমা ময়দানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।