বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের দেড়শ জনের প্রথম দলটিকে নিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টেকনাফের উনচিপ্রাং আশ্রয়কেন্দ্রে অপেক্ষায় ছিল ছয়টি বাস। তিন দিনের খাবার ও জরুরি জিনিসপত্রও তৈরি রাখা হয়েছিল।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের কাছে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ট্রানজিট ক্যাম্প। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের কর্মকর্তারাও দিনভর অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গারা কেউ ফিরতে রাজি হয়নি।
উনচিপ্রাং শরণার্থীর ক্যাম্পের খোলা জায়গায় জড়ো হয়ে বিভিন্ন বয়সের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা স্লোগান দিয়েছেন- ‘ন যাইয়ুম, ন যাইয়ুম’।
তারা বলেছেন, মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্ব, নাগরিক হিসেবে সব মৌলিক অধিকার এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ পাঁচ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিরতে চান না।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিকাল পর্যন্ত চেষ্টা করেছি। মিয়ানমারেও ওরা গেইট ওপেন রেখেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা এখনও মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিরাপদ বলে মনে করছে না। তারা আগ্রহী না হওয়ায় আজ কাউকে পাঠানো যায়নি। আমরা তো কাউকে জোর করে পাঠাতে পারি না।”
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি জানিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা গত কয়েক দিন ধরেই প্রত্যাবাসন শুরুর বিরোধিতা করে আসছিল।
প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী।
ওই ব্রিফিং শেষে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন, “বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে তাদের ইচ্ছার ভিত্তিতে। সেই নীতিতে অটল থাকার সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই।”
আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন, “একটা অপপ্রচার চালানো হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার তাদের জোর করে ফেরত পাঠাচ্ছে। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, যারা চাইবে কেবল তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে। জোর করে ফেরত পাঠানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি, কেন তাদের জোর করে তাড়াবো?”
‘নাগরিকত্ব ছাড়া ফিরব না’
গতবছর অগাস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গতবছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গত ৩০ অক্টোবর ঢাকায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মধ্য নভেম্বর সময় ঠিক হয়।
পরিকল্পনা হয়, প্রথম ধাপে কক্সবাজারের উখিয়ার জামতলী ও টেকনাফের উনচিপ্রাং আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ৪৮৫টি পরিবারের ২ হাজার ২৬০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। প্রতিদিন ১৫০ জন করে ১৫ দিনে শেষ হবে প্রথম ধাপের এই প্রত্যাবাসন।
এর মধ্যে দেড়শ জনের প্রথম দলটিকে বৃহস্পতিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য গত কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল প্রত্যাবাসন কমিশন। ফিরতি পথের রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে রাখার জন্য ঘুমধুম সীমান্ত থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ট্রানজিট ক্যাম্পও তৈরি রাখা হয়েছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল বাশেলেট মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো হলে তা হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চক্রে ছুড়ে ফেলার শামিল।
রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরার ‘অনুকূল পরিবেশ তৈরি’ হলে তাদের প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার জন্য গত এপ্রিলে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছিল বাংলাদেশ। পরে মিয়ানমার সরকারও ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে একই ধরনের সমঝোতায় আসে।
ওই সমঝোতায় বলা হয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা শরণার্থীরা যাতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে এবং এই প্রত্যাবাসন যাতে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে হয়, তা নিশ্চিত করতে সব পক্ষই কাজ করবে।
রোহিঙ্গাদের ফেরার বিষয়টি যে স্বেচ্ছায় হচ্ছে, তা নিশ্চিত করতে গত দুদিনে ৫০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা। তা নিশ্চিত করতে গত মঙ্গল ও বুধবার প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা প্রথম ৫০টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয় ইউএনএইচসিআর।
মূলত ইউএনএইচসিআরের ওই প্রতিবেদনের পরই বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। প্রেক্ষাপটে ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন সকালে জানায়, তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের কেউ যদি স্বেচ্ছায় ফিরতে চান, তাদের দুপুরে মিয়ানমারে পাঠানো হবে।
সে অনুযায়ী প্রত্যাবাসন কমিশনের কর্মকর্তারা উনচিপ্রাং আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বলেন, যারা ফিরে যেতে চান, তাদের নিয়ে যেতে সব প্রস্তুতি সারা হয়েছে।
কিন্তু তালিকায় থাকা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর অনেকের ঘর সে সময় ছিল তালাবন্ধ। রোহিঙ্গাদের নিতে ক্যাম্পে আসা ছয়টি বাস ঘিরে বিক্ষোভ করছিলেন নানা বয়সী মানুষ।
তাদের হাতে সাদা কাগজে ইংরেজিতে লেখা ছিল বিভিন্ন দাবির কথা। এর মধ্যে একটি কাগজে লেখা ছিল- ‘নাগরিকত্ব আর অধিকার ছাড়া কখনোই আমরা মিয়ানমারে ফিরব না’।
এখন কী হবে?
দুই দেশের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব না হলেও ‘প্রত্যাবাসন স্থগিত’ হয়েছে- এমন কথা মানতে রাজি নন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম।
রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা কখনোই বলিনি স্থগিত হয়েছে। তবে শুরু করা যায়নি এটা ঠিক। মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতির ওপর তারা (রোহিঙ্গারা) যদি ভরসা করতে না পারে সে দায় দায়িত্ব তো আমরা নেব না।”
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারার জন্য বাংলাদেশকেই দায়ী করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ট থু বৃহস্পতিবার নেপিদোতে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, দুই দেশের সম্মতিতে যে ফিজিকাল আরেঞ্জমেন্ট চূড়ান্ত রা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ দুর্বলতা দেখিয়েছে।”
মিয়ানমারের এই কর্মকর্তা বলেন, “দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী তাদের ফেরত নিতে আমরা প্রস্তুত আছি। এখন তারা আসবে কি আসবে না, সেটা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়।”
তবে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো ঢাকায় ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ফিরে যাওয়ার মত আস্থা যাতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হয়, ফিরে গেলে আগের মত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর হবে না- এই ভরসা যেন তারা করতে পারে, তা নিশ্চিত করা ছিল মিয়ানমারের দায়িত্ব।
“কার কোথায় দায়িত্ব, কিছু ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটা মিয়ানমার সরকারের দায়িত্ব।”
তবে গত কিছু দিনে রাখাইনের পরিস্থিতির ‘সামান্য যেটুকু’ উন্নতি মিয়ানমার দেখাতে পেরেছে, সে বিষয়টিকেও স্বাগত জানান মিয়া সেপ্পো।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অগ্রগতির ধারা আরও এগিয়ে নিতে একযোগে কাজ করে যাবে, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারে।