অপমানিত বোধ করেছি, তাই সভা বর্জন: মাহবুব তালুকদার

একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে দিনভর কমিশন সভা হলেও তা বর্জন করার পর নিজ কক্ষেই সময় কাটিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2018, 06:03 PM
Updated : 15 Oct 2018, 07:37 PM

মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দুই দফায় কমিশন বৈঠক করেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার।

সকালে সভা শুরুর ১০ মিনিটের মাথায় তা বর্জন করে বেরিয়ে আসেন মাহবুব তালকুদার। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সদস্যের ইসিতে এ নিয়ে দেড় মাসের মধ্যে পরপর দুটি কমিশন সভা বর্জন করলেন তিনি।

দিনভর মুখ না খুললেও বিকাল ৫টার পরে নির্বাচন ভবনে নিজের কক্ষে সাংবাদিকদের কাছে লিখিতভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন এই নির্বাচন কমিশনার। লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনালেও সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি তিনি।

গত বছরের ইসির সংলাপের প্রসঙ্গ টেনে মাহবুব তালুকদার বলেন, সংলাপের সুপারিশ বা প্রস্তাব সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো আলোচনা হয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক, গ্রহণযোগ্য করতে কিছু প্রস্তাব নিয়ে তিনি আলোচনা করতে চাইলেও তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি।

সভা বর্জনের বিষয়ে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “আমাকে নির্বাচন কমিশন সভায় তা উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি…৮ অক্টোবর ইসি সচিবালয় থেকে ইউও নোটের মাধ্যমে আমাকে আজকের সভায় তা উপস্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

“আমাকে আমার প্রস্তাবনা উপস্থাপনা করতে বলে তা উপস্থাপন করতে না দেওয়ায় অপমানিত বোধ করেছি।”

সকালে কমিশন সভা থেকে বেরিয়ে নিজের কক্ষে যাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার

এদিকে এ মাসেই ব্যক্তিগত সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন মাহবুব তালুকদার। ১০ দিন সেদেশে কাটিয়ে তিনি ৩১ অক্টোবর দেশে ফিরবেন বলে ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

মাহবুব তালুকদারের সভা বর্জন নিয়ে কোনো কথা বলেননি সিইসি নূরুল হুদা  কিংবা অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।

কমিশন সভা শেষে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, “মাননীয় নির্বাচন কমিশনার (মাহবুব) প্রথমে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন। উনার একটি বিষয় তিনি এজেন্ডাভুক্ত করার জন্যে অনুরোধ করেছেন।

“মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার মনে করেছেন, যেহেতু এটা এজেন্ডাভুক্ত নয়, তাই সভায় আলোচনা করার কোনো কারণ নেই। বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত না হওয়ায় তিনি সভা ছেড়ে চলে যান।”

ইসিতে মতানৈক্য বাড়ছে কি না- এ প্রশ্নে হেলালুদ্দীন বলেন, “এটা মাননীয় কমিশনের বিষয়। কমিশন যেভাবে মনে করেছেন সেভাবে আমাদের কাছে অনুমিত হয়েছে- চার নির্বাচন কমিশনার বলেছেন এজেন্ডাভুক্ত না হওয়ায় আলোচনার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ইসি সচিব হিসেবে আমি মন্তব্য করতে চাই না।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, “(নির্বাচন কমিশনারের বর্জনে) আমাদের সভা বিঘ্নিত হয়নি। আমরা দিনব্যাপী বৈঠক করেছি। যত কাজ রয়েছে সেগুলো চার নির্বাচন কমিশনারকে আহ্বায়ক করে তদারক করার বিষয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

কমিশনের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ

মাহবুব তালুকদার বর্জনের আগে নোট অব ডিসেন্টে লিখেছেন, “নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার অধিকার খর্ব করতে পারে না, বাক স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা আমার সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার।

“এমতাবস্থায় অনন্যোপায় হয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করছি এবং প্রতিবাদ স্বরূপ কমিশন সভা বর্জন করছি।”

মাহবুব তালুকদার লিখেছেন, কমিশন সভায় তাকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে না দেওয়ার বিষয়ে কমিশনারদের ‘অভিন্ন অবস্থান’ তাকে ‘বিস্মিত ও মর্মাহত’ করেছে।

ওই পাঁচ দফা প্রস্তাব কমিশন সভার কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করারও অনুরোধ করেন এই নির্বাচন কমিশনার। 

মাহবুব তালুকদারের ৫ সুপারিশ

ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন: ইসির সংলাপে ২৬টি দল সেনা মোতায়েনের পক্ষে ও তিনটি দল বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর সব নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হয়েছে। তবে তা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে।

ভোটে সেনা মোতায়েন হলেও তারা কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে তা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আইন শৃংখলাবাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনী বাদ দেওয়ার পর তাদের কার্যপরিধি কেমন হবে তা নির্ধারিত হওয়া উচিত।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন: দশম সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এ নির্বাচনটি একটি দল বর্জনও করেছে। তবে বর্তমান বিরোধী দল সরকারের পাশাপাপাশি মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছে। এ অবস্থায় কীভাবে একটি দল সরকারে ও বিরোধী দলে থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কঠিন সমস্যারও সমাধান হতে পারে।

সকালে কমিশন সভা থেকে বেরিয়ে আসছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার

নির্বাচনে নিরপেক্ষতা: ভোটে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি নির্বাচনের পূর্বশর্ত। …রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ক্ষমতাসীন দল যে সুবিধা ভোগ করে বিরোধী দল তা ভোগ করতে পারে না। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের কমিটি ধরে ধরে মামলা দায়ের ও গায়েবি মামলা দায়েরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণার আগে ইসি সম আচরণ নিশ্চিতে বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

ইসির সক্ষমতা বৃদ্ধি: নির্বাচনকালে সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে ন্যস্ত করতে বলেছেন অনেকে। এ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ইসির কাছে অর্পিত হলে জন আস্থা বেড়ে যাবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তা সহায়ক হবে।

সরকারের সঙ্গে সংলাপ: এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য মনে হলে তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের সঙ্গে তা নিয়ে ইসির সংলাপ করা উচিত।