ইভিএম আবার আলোচনায়

এতদিন নীরব থাকার পর সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হঠাৎ নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে তোড়জোড় শুরু করায় তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2018, 05:42 PM
Updated : 30 August 2018, 06:33 AM

স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার করলেও ইসি এতদিন বলে আসছিল, সব দলের সম্মতি না পেলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না।

কিন্তু ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির মধ্যেই বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে ইসি; পাশাপাশি সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচনী আইনে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও) সংশোধনী আনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

আরপিও সংশোধন নিয়ে গত ২৬ অগাস্ট বৈঠকে বসেছিল ইসি; সেই বৈঠকটি মুলতবি হওয়ার পর বৃহস্পতিবার আবারও বসতে চলছে কমিশন।

শেষ সময়ে ইসির এমন উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি; যারা শুরু থেকেই ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে।

ভোট চুরির কৌশল হিসেবে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে দাবি বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

ইসির বৈঠকের আগের দিন বুধবার এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার আমরা মানি না। ইভিএম ব্যবহার ও আরপিও সংশোধনের যে অপচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে তা থেকে নির্বাচন কমিশনকে বিরত থাকার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”

অন্যদিকে শুরু থেকে ইভিএমের পক্ষে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইসির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি বিএনপির বিরোধিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বুধবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, “নির্বাচন কমিশনই এর মধ্যে ঘোষণা করেছে, ৩০০ এর মধ্যে ১০০টি আসন বা এক-তৃতীয়াংশ ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব। আমরা স্বাগত জানাই নির্বাচন কমিশনকে।”

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসির হাত ধরে ২০১০ সালে। তখন বুয়েটের সহায়তায় ইভিএম তৈরি করে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

ইসির প্রথম ইভিএম

তখন বলা হয়েছিল, ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়িয়ে কাগজে ব্যালটের ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে। কারণ এতে অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ভোটগ্রহণে সময় লাগে কম, ফলও পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।

এরপর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি ইভিএম নিয়ে আর বেশি এগোয়নি; ব্যাটারি ব্যবহার নিয়ে বুয়েটের সঙ্গেও দেখা দিয়েছিল দ্বন্দ্ব; ইভিএমগুলোও হয়ে পড়ে অকেজো। ২০১৩ সালের পর ইভিএম ব্যবহার থেমে যায়।

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ইভিএম নিয়ে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সহায়তায় তৈরি করা হয় ‘ডিজিটাইজড ইভিএম’।

ইসির বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক মো. হায়দার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ইসির বর্তমান ইভিএম শক্তিশালী। এ যন্ত্রে কোনোভাবেই কারসাজি করে একজনের ভোট অন্যের দেওয়ার সুযোগ নেই।

“এখানে অটোমেটিক ভেরিফিকেশন হয়েই ব্যালট ইস্যু হবে। ফিঙ্গার প্রিন্ট অথবা এনআইডি দিয়েই শনাক্ত করে ব্যালট-ভোট ইউনিটে ভোটারকে স্বয়ং উপস্থিত হয়েই ভোট দিতে হবে।”

নতুন ইভিএম দিয়ে স্থানীয় নির্বাচন করলেও সিইসি নূরুল হুদা গত বছরের নভেম্বরেও এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি ইসির নেই।

কিন্তু মাসখানেক ধরে ইসির নানা তৎপরতায় জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনার আঁচ পাওয়া যায়।

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহৃত নতুন ইভিএম

নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য যেহেতু নির্বাচন কমিশনের চিন্তাভাবনা আছে, তাই এটা আমরা পজিটিভভাবেই দেখছি।”

তবে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তা আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে জানান তিনি।

কিছুটা সংশয় রেখে কবিতা খানম বলেন, “যেহেতু লোক-বলের ব্যাপার আছে। আর জাতীয় সংসদের সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার উপযোগী করতে হলে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সক্ষম জনবল লাগবে, ভোটারদের এডুকেশন, স্টেক হোল্ডারদের আস্থার বিষয় রয়েছে।”

দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

স্থানীয় সরকারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১-১০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট করার পর বড় পরিসরের জন্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প নিতে চাইছে ইসি।

৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের  অধীনে দেড় লাখ সেট ইভিএম কেনার পরিকল্পনা ইসির। এরমধ্যে ইভিএম কেনায় ৩৫১৫.৬১ কোটি টাকা; প্রচারে ৫ কোটি টাকা; পরিবহনে ৭ কোটি টাকা, মোটর যানে ৩.৩ কোটি টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যারে ৫০ কোটি টাকা, আসবাবপত্রে ৭৫ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।

প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) এর সভায় উপস্থাপনের জন্য ‘ইভিএম কেনা, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে ইসি সচিবালয় থেকে।

ইসি সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধান সাইফুল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “‍আমরা পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি সভার জন্য ইভিএমের একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। রোববার এ সংক্রান্ত সভা স্থগিত করা হয়। আশা করছি, আগামী মাসে পিইসি সভায় তা উঠবে।”

রোববার পিইসি সভা স্থগিত হলেও প্রকল্পের জনবল অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়ার পরেও আরও কয়েক ধাপে পিইসি সভা হবে। পরিকল্পনা কমিশনের নিজস্ব কিছু মতামত থাকবে প্রকল্প নিয়ে। এসব মতামত পূরণ সাপেক্ষে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে।

এ ইভিএম একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে কি না, সে বিষয়ে কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান সাইফুল।

জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে ভোট, ভোটকক্ষে ও সম্ভাব্য ইভিএম ব্যবহার চিত্র

নির্বাচন

নির্বাচনী আসন/স‌ংস্থা

সম্ভাব্য ভোটকেন্দ্র

সম্ভাব্য ভোটকক্ষ

ইভিএম (প্রতিকেন্দ্রে ১টি অতিরিক্ত ধরে)

ইউপি নির্বাচন

৪৫৫৫

৪৫,৫০০

২,৭৩,০০০

৩,১৮,৫০০

প্রথম ধাপে নির্বাচন

৭৫০

৭,৫০০

৪৫,০০০

৫২,০০০

পৌরসভা নির্বাচন

৩২৩

৫,০০০

৩০,০০০

৩৫,০০০

সিটি করপোরেশন নির্বাচন

১১

৫,০০০

৩০,০০০

৩৫,০০০

ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি

৩৩০০

২০,০০০

২৩,০০০

সংসদ নির্বাচন

৩০০ আসন

৪৪,০০০

২,২০,০০০

২,৬৪,০০০

অর্ধেক নির্বাচনী এলাকা

১৫০ আসন

২২,০০০

১,১০,০০০

১,৩২,০০০

সূত্র: ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয় শাখা

প্রকল্পের সার সংক্ষেপ

>> সরকারি অর্থায়নে প্রাক্কলিত ব্যয়- মোট ৩৮২৯.০৭ কোটি টাকা

>> বাস্তবায়নকাল- শুরু জুলাই ২০১৮ থেকে সমাপ্তি জুন ২০২৩

>> উদ্দেশ্য- ভোটপ্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ১,৫০,০০০ সেট ইভিএম প্রচলনের মাধ্যমে ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি; ইসি সচিবালয়ের ৩১১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি; নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বিষয় সচেতনতা বৃদ্ধি।

নির্বাচন ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে ইভিএম কেনা, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব করেছে ইসি।

প্রস্তাবে ইসি যুক্তি দেখিয়েছে এই প্রকল্পটি সামগ্রিক ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন সাধন করবে।