ইভিএম: ইসি কতটা প্রস্তুত?

একাদশ সংসদ নির্বাচন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা এবং বিএনপির বিরোধিতা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে আলোচনা চললেও নির্বাচন কমিশন আগামী দুই বছরের মধ‌্যে সারা দেশে এ প্রযুক্তিতে ভোট আয়োজনে প্রস্তুত হতে পারবে কি না সে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2017, 05:42 PM
Updated : 17 Feb 2017, 05:43 PM

বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর আগে রাজনৈতিক ঐকমত‌্য তৈরির পাশাপাশি এ প্রযুক্তির ওপর সাধারণের আস্থা আনতে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম এবং আইন ও বিধি সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

ই-ভোটিং হল ভোট গ্রহণ ও দ্রুত গণনার ইলেকট্রনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ছাপানো ব‌্যালট পেপার, বাক্স আ সিল লাগে না। ভোটার একটি যন্ত্রে বোতাম চেপেই তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং গণনা হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে।

ওই যন্ত্রকে বলা হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, সংক্ষেপে ইভিএম। ভোট দেওয়ার জন‌্য একটি ব‌্যালট ইউনিট এবং তথ‌্য সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন‌্য

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন এ পদ্ধতিতে করতে চাইলে প্রতিটি ভোটকক্ষে অন্তত একটি ব‌্যালট ইউনিট ও একটি কন্ট্রোল ইউনিট লাগবে। যান্ত্রিক গোলযোগ এড়াতে প্রতি কেন্দ্রে রাখতে হবে বাড়তি ইভিএম।

অর্থাৎ, সারা দেশে তিন লাখের বেশি ভোট কক্ষে ইভিএমে ভোট করতে হলে স্বল্প সময়ে তার চেয়ে বেশি যন্ত্র প্রস্তুত করতে হবে, যেগুলো বিগড়ে না গিয়ে নির্ভুল কাজ দেখাতে পারবে।

গত সপ্তাহে শপথ নেওয়া নতুন নির্বাচন কমিশনের জন‌্য মাত্র ২২ মাসের মধ্যে এত যন্ত্র প্রস্তুত করার পাশাপাশি কয়েক লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে; ভোটারদের করতে হবে সচেতন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

 

ইভিএম বৃত্তান্ত

>> বাংলাদেশের ভোটারদের সঙ্গে ইভিএমের প্রথম পরিচয় ঘটে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে ইভিএম ব‌্যবহার করা হয়।

>> এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন সাত বছর আগে যখন এ পদ্ধতি চালুর উদ‌্যোগ নেয়, তখন সন্দেহ থেকে এর বিরোধিতা করেছিল বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল। তবে চট্টগ্রামের সাফল‌্যের পর নায়ায়ণগঞ্জের কয়েকটি ওয়ার্ডে, নরসিংদী পৌরসভা ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের পুরো নির্বাচন ইভিএমে করা হয়। 

>> ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ের আগে সংসদ নির্বাচনের জন্য ইভিএমের প্রস্তুতি রেখে গিয়েছিল শামসুল হুদার কমিশন। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজশাহী ও রংপুরে ছোট পরিসরে ইভিএম ব‌্যবহার করা হয়।

>> সে সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং গাজীপুরের রাষ্ট্রায়ত্ত মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সহায়তায় এ প্রযুক্তি চালু হলেও পাঁচ বছরের মাথায় কারিগরি ত্রুটি নিয়ে ইসি-বুয়েট দ্বন্দ্বে ইভিএম অধ্যায়ে ছেদ পড়ে।

>> কাজী রকিবের কমিশন এরপর আর ইভিএম ব‌্যবহার না করলেও মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে গতবছর নতুন করে তৎপর হয়। এর কারিগরি দিক ও ব্যবহার পর্যালোচনা করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১৯ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়।

>> নতুন ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন শপথ নেওয়ার দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ইভিএমে করার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।

>> এর বিরোধিতায় দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি বলে আসছে, ইভিএম ফেরানোর উদ‌্যোগ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’। এর মাধ‌্যমে জাতিকে হয়ত ‘আরেকটি ভেল্কিবাজি’ দেখতে হবে।

ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নতুন কমিশনের সদস্যরা

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনের অধীনে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে (নভেম্বর-জানুয়ারি) একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ওই ভোট করতে ইসি কতটা সক্ষম তা বোঝার চেষ্টায় ইভিএম নিয়ে গঠিত কারিগরি কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান, নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং ইসি সচিবালয়ের সাবেক দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ

এটা একেবারেই প্রিম্যাচিউর অবস্থায় আছে। এ প্রযুক্তি কতটুকু কার্যকর হবে- তা পর্যালোচনার জন্যে কমিটি কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন পেলে হয়ত অগ্রগতি বোঝা যাবে।

নতুন কমিশন আসার পর ইভিএম নিয়ে কোনো কথা হয়নি। ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশনের প্রথম বৈঠক হবে। ইভিএম নিয়ে কোনো আলোচনা হলে বা নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম চালু করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সবার ঐকমত‌্য। দল, গণমাধ‌্যম, নাগরিক সমাজসহ সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেই এগোতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের মত বড় পরিসরে যাওয়ার আগে পরীক্ষামূলক কাজও সারতে হবে।

এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী

আমরা গত দেড় মাসে মাত্র একটি বৈঠক করেছি। ইসির এ প্রযুক্তি কতটুকু ব্যবহার উপযোগী, ত্রুটি যাচাই-বাছাই, সঠিকতা- সব কিছুর পর্যালোচনা চলছে। মাত্র দুই ঘণ্টার একটি ব্রিফিং পেয়েছি, একটি সাব কমিটি করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পেলে হয়ত কথা বলা যাবে। আগাম কিছু বলতে চাই না।

নতুন কমিশন এসেছে, প্রকল্প পরিচালকও নতুন। তারা কতটুকু এগিয়েছেন তাও জানতে পারিনি। আশা করছি, পরবর্তী মিটিংয়ে জানতে পারব।

ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান

টেকনিক্যাল কমিটির প্রথম বৈঠকের সারসংক্ষেপ তৈরি হয়েছে। ১৮ সদস্যের এ কমিটির বিশেষজ্ঞরা ইভিএমে নতুন কিছু সংযোজন, বিয়োজনের পাশাপাশি ত্রুটি বিচ্যুতি সারানোর বিষয়ে কিছু সুপারিশ করেছেন। সব পর্যালোচনার জন‌্য আরও বসতে হবে। পরে কমিশনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।

এ প্রযুক্তি কোনোভাবে যেন হ্যাক করা না যায়, নির্ভুল যেন হয়, মানে ফুলপ্রুফ করেই ব্যবহার করতে হবে। জনমনে বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরীক্ষামূলক কার্যক্রমও নিতে হবে। তার আগে দরকার আইন ও বিধি সংস্কার করা।

গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের নতুন ভবন উদ্বোধন হলেও তার সামনে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটির নাম এখনও দেওয়া হয়নি। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

দুই বছরের কম সময়ে ইভিএম চালু করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে ইসি সচিব আব্দুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে আমরা স্বল্প সময়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারব। কিন্তু তার আগে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাও সারতে হবে। এ প্রযুক্তি কতটা দক্ষভাবে কাজ করছে তা বুঝতে স্বল্প পরিসরে পাইলটিং করতে হবে।”

দশ কোটির বেশি ভোটারকে ইভিএম নিয়ে সচেতন করা, বিশাল কর্মী বাহিনীকে দক্ষ করে প্রস্তুত করা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ- সব কিছু বিবেচনায় নেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

“আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির দিকে যেতে হবে। তা একাদশ সংসদ হোক বা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হোক- ইভিএমকে এগিয়ে নিতে হবে।”

ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন ও বিধিতে ইভিএম ব‌্যবহারের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। করা হয়েছে আলাদা আলাদা বিধিমালাও। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাতেও ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। এখন সংসদ নির্বাচনের আইন ও বিধিতে সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।  

সদ্য বিদায় নেওয়া ইসির অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভিএম সংসদে ব্যবহারের জন্য বর্তমানে আইন-বিধি নেই। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম চালুর জন‌্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে এবং আলাদা ইভিএম বিধিমালা করতে হবে। আগের কমিশন আইন সংস্কারের সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।”

তবে নির্বাচন কমিশনের একজন সাবেক কর্মকর্তা বলছেন, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ স্বল্প সময়ে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। শুধু আইন সংস্কার করলেই হবে না, ইভিএম নির্ভরযোগ‌্য কি না সা যাচাই করে ভোটারদেরও আশ্বস্ত করতে হবে। গ্রামেগঞ্জে ইভিএম ব্যবহারের অবকাঠামো সুবিধা তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে মেটাতে হবে রাজনৈতিক মতবিরোধ।

“পাঁচ বছর আগে যাত্রা করেও থমকে যাওয়ায় এ প্রযুক্তি নিয়ে সন্দেহ বেড়েছে। এ সংশয় কাটাতে নতুন কমিশনকে স্বচ্ছভাবে কাজ করতে হবে। কমিশনের কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হলে কোনো এক সময় সারা দেশ ইভিএম দেখবে।”