ফাঁসে আলোচিত জেএসসির প্রশ্নেও ভুল

নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ জেএসসি পরীক্ষায় এবার ভুলে ভরা প্রশ্ন নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2017, 04:06 PM
Updated : 15 Nov 2017, 04:26 PM

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ইংরেজি সংস্করণের ‘হোম সায়েন্স’ বিষয়ের সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নে ১২টি ভুল পাওয়া গেছে।

শিক্ষকদের অবহেলার কারণেই প্রশ্নে এ ধরনের ভুল হচ্ছে মন্তব্য করে এজন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষা হচ্ছে ভুল থেকে শুদ্ধ হতে শেখা। শিক্ষক নিজে ভুল করলে সে শিক্ষার্থীদের ভুল ধরবে কী করে?

“পরীক্ষার কোনো প্রক্রিয়ায়ই, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল তৈরির কোনো ক্ষেত্রেই সামান্য ভুলের অবকাশ নেই। এটি কর্তব্যে অবহেলা, যা আমলযোগ্য অপরাধ; এটি মোটেও উচিত নয়।”

চলতি জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিদিনই প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে; সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে কেন্দ্রের বাইরে জটলা পাকিয়ে স্মার্টফোনে প্রশ্ন ও তার উত্তর দেখছেন শিক্ষার্থীরা। আগের রাতে ঘোষণা দিয়ে ফেইসবুক পেইজ ও গ্রুপেও ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন শিক্ষার্থীরা। এই প্রেক্ষাপটে পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে তা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। এরমধ্যে মঙ্গলবার ভুলে ভরা প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন উদ্বেগ।

প্রশ্নপত্রে ভুল

মঙ্গলবারের ‘হোম সায়েন্স’ পরীক্ষার সৃজনশীল অংশের ৮ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপকে গৃহকর্ত্রীর মেয়ের নাম সায়মা উল্লেখ করা হয়। অথচ এর ‘d’ নম্বর প্রশ্নে এ নামটি লেখা হয়েছে ‘সাবিনা’।

১০ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপকে ‘Asma khatun buys a light coloured soft dress for her two years old daughter, Maisha, the button of which of dress are set at the back’ লেখা হয়েছে, যেখানে বাক্যগঠনে রয়েছে অসঙ্গতি।

এ উদ্দীপকের ‘a’ নম্বর প্রশ্নে phonek শব্দটি লেখা হয়েছে ‘fonek’ বানানে।

১১ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপক অংশের প্রথম বাক্যটি লেখা হয়েছে এভাবে- ‘Jakia buys a dress of soft fibre with back button for her friend Jakia's newly born baby Munni.’ এখানে বাক্যের অর্থ স্পষ্ট নয়। এই উদ্দীপকের দ্বিতীয় বাক্যে 'atteneded' লেখা হয়েছে, যার সঠিক বানান 'attended'.

প্রশ্নপত্রের বহু নির্বাচনী ৩০টি প্রশ্নের ৬টি প্রশ্নেই ভুল রয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বর প্রশ্নটি ছিল- ‘The food element need work-efficiency and sports of the pre-school children are-’, যেটির বাক্য গঠনই হয়নি।

১২ নম্বর প্রশ্নে ‘Overies’ (সঠিক বানান- ‘Ovaries’), ১৩ নম্বর প্রশ্নে ‘dificit’ (সঠিক বানান- ‘deficit’), ১৯ নম্বর প্রশ্নের উত্তরের ‘b’ নম্বরে ‘Backing’ (সঠিক বানান- ‘Baking’), ২৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তরের ‘a’ নম্বরে ‘Salf’ (সঠিক বানান- ‘Salt’) বানানগুলো ভুল লেখা হয়েছে।

২৭ নম্বর প্রশ্নের উত্তরের ‘a’ তে Ethophane এর বানান ভুল করে লেখা হয়েছে ‘Ethofen’।

প্রশ্নপত্রে ভুল থাকায় উত্তরে ভুল করার কথা জানিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকটি প্রশ্নে এমন ভুল ছিল যে, তাতে আমাদের চিন্তা করতে করতে অনেক সময় লেগেছে। আর প্রশ্নে ভুল থাকায় অনেকেই ২-৩ টি করে ভুল উত্তর দিয়ে এসেছি।”

এই প্রতিষ্ঠানের আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, “প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নেই কিছু না কিছু ভুল থাকে। কেউ এর সংশোধনের কথা জিজ্ঞেস করেনি, তাই আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আর বোর্ড পরীক্ষায় সংশোধনও হয় না প্রশ্ন, তাই শিক্ষকদের কিছু না বলে নিজের মতো করেই উত্তর দিয়েছি।”

প্রশ্নে ভুল থাকায় সন্তানের পরীক্ষার ফল নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে নাজমা আক্তার নামে একজন অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের ভুলের কারণে তারা ভুল উত্তর দিচ্ছে, সময় নষ্ট করছে; এতে ফলাফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় ভুল প্রশ্নে তারা ঘাবড়ে যাচ্ছে। বোর্ড পরীক্ষার মতো এত বড় পরীক্ষায় এমন ভুল থাকা ঠিক না।”

ভুল প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের উপর চাপ তৈরি করে মন্তব্য করে অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, “ভুল প্রশ্ন থাকলে শিক্ষার্থীরা সঠিক উত্তর দিতে দ্বিধায় পড়ে। আর সঠিক পড়েছে যারা তাদের কাছে এ ভুলটা মারাত্মক মনে হয়। কারণ আমরা কেউই প্রশ্নে ভুল আশা করি না, আর শিক্ষকদের করা প্রশ্নে ভুল থাকলে শিক্ষার্থীর আস্থার জায়গায় চিড় ধরে।”

প্রশ্ন তৈরির পর তার ভুল-ত্রুটি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা মডারেটরদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা ভুলগুলো ধরতে পারত তাদেরও তেমন প্রশিক্ষণ বা যোগ্যতা থাকে না। অনেকের শিক্ষার অভাব, তারা সঠিকটা জানে না হয়ত। প্রশ্ন তৈরির পর তা চেক করার ধৈর্য, ইচ্ছা, সময় বা যোগ্যতা তাদের নেই। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সঠিক, যোগ্য মানুষদের যুক্ত করা উচিত।

“এখানে যোগ্য মানুষ দেওয়া হোক। অনেক যোগ্য মানুষ চাকরি না পেয়ে বেকার ঘুরে বেড়ায়। তাদের এসব দায়িত্ব দেওয়া হোক।”

এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের এখানে মনিটর করা দরকার, যারা ভুল করছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। জবাবদিহি না করতে পারলে তাদের অপসারণ করা উচিত, এভাবে চলতে পারে না।

“যারা ভুল করছেন তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত, নিজেদের সংশোধন করা উচিত। আর ভুল থেকে সঠিক হতে না পারলে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হওয়া উচিত না।”

মনজুরুল ইসলাম বলেন, “শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে ভালো শিক্ষা দেওয়া শিক্ষকের কাজ, সেখানে তারা ভুল করলে শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দিবে?

“শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের ভুল প্রশ্নের জন্য জনস্বার্থে কোর্টে মামলা করা উচিত। তাহলে হাই কোর্টের একটা আদেশ আসবে, সরকারের কাছে ইনস্ট্রাকশন চলে যাবে।”

এ বিষয়ে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক জিন্নাত পারভীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশ্নে ভুল থাকা একেবারেই কাম্য নয়। আমরা আমাদের ক্লাসের প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে সতর্ক থাকি। কারণ এটি বাচ্চা ও অভিভাবকদের কাছে চলে যায়। তখন এটি ভাবমূর্তি নষ্ট করে।”

তিনি বলেন, “বোর্ড প্রশ্নে এ ধরনের ভুল একেবারেই গ্রহণীয় নয়। প্রশ্নে ভুল থাকলে সেটি বুঝতে গিয়ে বাচ্চাদের সময় নষ্ট হয়, ভুল উত্তর দেয়, চিন্তায় সময় যায়।”

প্রশ্নপত্রে ভুল নিয়ে বক্তব্যের জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।