‘সুন্দরবন রক্ষায়’ রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণ বন্ধে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সভা থেকে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধীরা।
Published : 02 Jul 2017, 06:19 PM
এছাড়া ব্যাংক আমানতে আবগারি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ভ্যাট আইন প্রত্যাহারের মতো ‘ভোটের আগে’ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান তাদের।
রোববার সন্ধ্যায় পোলান্ডে শুরু হতে যাওয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভাকে সামনে রেখে দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ওই সভা থেকে ‘বিজ্ঞানসম্মত তথ্য-যুক্তি ও সুন্দরবনের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে’ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেন সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের কোর গ্রুপের সদস্য বাপার সহ-সভাপতি রাশেদা কে চৌধুরী।
সরকার ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে অভিযোগ করে লিখিত বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, “ইউনেস্কোর সভায় রাজনৈতিক বিবেচনায় রামপালের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।”
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশে একাংশের বিরোধিতার মধ্যে গত বছর জাতিসংঘ ও পরিবেশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন আইইউসিএনের একটি দল রামপাল পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দেয়।
পোলান্ডে ২ জুলাই থেকে শুরু হয়ে যাওয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে রামপালবিরোধীরা বলছে, ওই সভা থেকে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পক্ষে বা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাশেদা কে চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, “পশুর নদীর পাশের গ্রামের বাসিন্দারাও চাচ্ছে না রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। কিন্তু তাদের কথা শোনা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে আমরা সে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছি, সেখানে জনপ্রতিনিধিরাও ছিল। কিন্তু তারা সেই এলাকার বাসিন্দাদের কথা শুনছে না।
“আমরা চাই, সরকার তার ভুল অবস্থান থেকে সরে এসে রামপাল প্রকল্প বাতিল করে বনবিরোধী সকল স্থাপনা উৎখাত করে বনের প্রাকৃতিক চরিত্রকে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধকরণে সঠিক পদক্ষেপ নিক।”
সুন্দরবন নষ্ট করে বিদ্যুৎ চান না জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার বলছে এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে (প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট)। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে তা ২৪ হাজার মেগাওয়াট করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সুন্দরবন নষ্ট করে উৎপাদিত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ না হলেই কি নয়? জাতির বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন, নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন।”
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও তার ৫৩টি সদস্য সংগঠন ‘একাধিকবার বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসিদ্ধ উপায়ে সরকারি পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনের অসারতা’ তুলে ধরলেও সরকার কোনো কিছুই আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ রাশেদার।
“রামপাল প্রকল্পের কারণে সেখানকার মাটি-পানি-ফসল-বন-মৎস্য-বনের গাছপালায় যাবতীয় রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, জাহাজ চলাচল, কয়লা পরিবহন, নদী ড্রেজিং জনিত দূষণ ও জনস্বাস্থ্য ক্ষতিসহ অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি হবে বলে আমরা প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছি। কিন্তু সরকার তার কোনো বিজ্ঞানসম্মত সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি। তাদের সকল সিদ্ধান্তই হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে।”
ইউনেস্কোর সভার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম আকাশ বলেন, “ইউনেস্কোর অধিবেশনের পর যদি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তারা নাকচ করে দেয়, তখন সরকার কী করবে সেটাই দেখার বিষয়।
“তবে ইউনেস্কো যদি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে থাকে তারপরও সুন্দরবন বাঁচাতে আমাদের আন্দোলন চলবে।”
এসময় ২০১৯ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারে বলে তার ধারণার কথা জানান অধ্যাপক আকাশ।
একই আহ্বান জানিয়ে কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভোটের কথা বিবেচনা করে সরকার ভ্যাট আইন, ব্যাংকের আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। আমরা চাই, ভ্যাট আর আবগারি শুল্কের মতো এই প্রকল্পও সরকার স্থগিত করুক। আমরা বলছি এটা সরিয়ে নিতে, বাতিল করতে নয়।
“আর যদি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়, তাহলে তা হবে সরকারের ‘আল্ট্রা সুপার একগুয়েমি’। সারা পৃথিবী বলবে, সুন্দরবনের মতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ধ্বংস হয়ে গেলেও ওদের কোনো চিন্তা নাই।
“আমরা যদি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করি, তাহলে আমরা বিরাট বদনামের ভাগিদার হব। সুন্দরবনের পানি-মাছ-ডলফিন যদি কথা বলতে পারত, তাহলে তারাও এটি বাতিল চাইত।”
ভারতের গুজরাট ও শ্রীলংকায়ও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প বাতিলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “প্রত্যেক দেশেই গণতান্ত্রিক সরকার নাগরিক উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
“আমরা পরিবেশবাদীরা তো অবৈতনিক উপদেষ্টার মতো কাজ করি। বিনা বেতনে উপদেশ দেই। অন্যান্য দেশেও দেয়। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা হচ্ছি সৎ সন্তানের মতো।”
সরকার ‘পরিবেশ ও জাতির’ কথা বিবেচনা করে এই প্রকল্প থেকে সরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন সৈয়দ মকসুদ।
সরকারের এই প্রকল্প নির্মাণে অনড় থাকার পেছনে সন্দেহ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বদরুল ইমাম বলেন, “রামপালের পক্ষে দেশি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বক্তব্য আসার পরও সরকার কেন এখনও অনড়?
“কোনো প্রচ্ছন্ন শক্তি সরকারকে এটি করতে বাধ্য করছে? শ্রীলংকা কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে সোলার করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমরা পারছি না কেন?”
তিনি বলেন, “পশুর নদীর ধার ঘেঁষে এ প্রকল্প করা থেকে সরে আসতে হবে। আমরা বিকল্প জায়গা হিসেবে বরগুণা ও পায়রার নামও প্রস্তাব করেছিলাম।”
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বাপার সাথারণ সম্পাদক ও সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আবদুল মতিন উপস্থিত ছিলেন।