মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টিকে একটি ‘রাজনৈতিক সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সামরিক কায়দায়’ এর সমাধান সম্ভব নয়।
Published : 08 Dec 2016, 03:37 PM
ডেনমার্কের নতুন রাষ্ট্রদূত মিকায়েল হেমনিড ভিনটার বৃহস্পতিবার সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এলে শেখ হাসিনা তাকে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম পরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানান।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি বাংলাদেশ সরকার যেভাবে সামলাচ্ছে, তার প্রশংসা করেছেন ডেনমার্কের নতুন রাষ্ট্রদূত।
“এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘ইট ইজ এ পলিটিক্যাল প্রবলেম, ইট ক্যান নট বি রিজলভড মিলিটারিলি’।”
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান এক সময় স্বাধীন রাজ্য থাকলেও অষ্টাদশ শতকের শেষভাবে বার্মার রাজা ওই এলাকা দখল করে নেন। আরাকানে জাতিগত বিভেদ তখন থেকেই।
গত শতকের চল্লিশের দশকের পর আরাকানে বৌদ্ধ মগ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে বহুবার জাতিগত দাঙ্গা লেগেছে। সামরিক শাসনামলে মিয়ানমারে ওই রাজ্যে চলেছে দফায় দফায় দমন অভিযান। রোহিঙ্গাদের বিভিন্নসংগঠন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পথেও হেঁটেছে।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে গত শতকের ৮০ এর দশক থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শিরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমারের সাড়া পাওয়া যায়নি।
এরমধ্যে গত অক্টোবরে চেকপোস্টে হামলায় ৯ সীমান্ত পুলিশ নিহত হওয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী পুলিশ একযোগে রোহিঙ্গাদের সাজা দিতে মাঠে নেমেছে। এর ফলে বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে শরণার্থীর স্রোত শুরু হয়েছে।
মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাত করতে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালাতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে মিয়ানমার সরকারের দাবি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিতে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান জানানো হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সংসদে বলেন, “আমরা দুয়ার খুলে দিয়ে কাউকে স্রোতের মতো আসার সুযোগ করে দিতে পারি না।”
শরণার্থী হিসেবে থাকা রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া এবং জালিয়াতি করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের বিষয়টিতে জোর দিয়ে ২০১২ সালে নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আর ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শেখ হাসিনার সরকার। এবারও সেই পদক্ষেপই নেওয়া হচ্ছে।
ডেনিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার রাতেও সংসদে রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনায় কথা বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “১৯৯১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন একবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখন ওই সরকার একেবারে দরজা খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ব্যবস্থা করেছিল।
“আমাদের এখানে ৩০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। কিন্তু অনিবন্ধিত আছে কয়েক লাখ। আমাদের ছোট দেশ, এখানে যদি এভাবে রোহিঙ্গা আসে, সেটা হবে আমাদের জন্য বিরাট বোঝা।”
তারপরও নানা ফাঁক-ফোকর গলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার করছে বলে সংসদকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ডেনিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে শরণার্থী সঙ্কট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা নিহত হওয়ার পর ছয় বছর নিজের নির্বাসিত জীবনের কথা স্মরণ করেন।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানিতে যান শেখ হাসিনা। এরপর ১৫ আগস্ট ঢাকার ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। পাঁচ বছর নয় মাস পর বিদেশে থাকার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।
বৈঠকে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথাও প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন বলে প্রেস সচিব জানান।
তিনি বলেন, “ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগী হতে পেরে তার দেশ গর্বিত। তাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”
ইহসানুল করিম জানান, রাষ্ট্রদূত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতিরও প্রশংসা করেন এবং জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে দুই দেশের সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে যে লক্ষ্য ঠিক করেছে তা অর্জনেও সহযোগী হিসেবে পাশে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন ডেনিশ রাষ্ট্রদূত।
প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, তৃণমূলের উন্নয়ন নিশ্চিত করাই তার সরকারের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিনিয়োগ করে ডেনমার্ক তাতে ভূমিকা রাখতে পারে।
মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীও সাক্ষাতকালে উপস্থিত ছিলেন।