বাংলাদেশে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা: বার্নিকাট

একের পর এক লেখক, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট, শিক্ষক খুনের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, বাংলাদেশে ‘এমন এক পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে, যেখানে দুর্বৃত্তরা অপরাধ করেও ‘পার পেয়ে’ যাচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2016, 11:01 AM
Updated : 28 April 2016, 12:14 PM

বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বার্নিকাট।

গত শনি থেকে সোমবারের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক, ইউএসএআইডির এক কর্মী ও তার এক বন্ধুকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে দুর্বৃত্তরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে।

“যে ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে তা পুলিশ বা সরকারের একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, কারও পক্ষেই একা তা সম্ভব না। জয়েন্টলি কাজ করতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে চাচ্ছে।”

সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় বাসায় ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয় ইউএসএআইডি বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল অ্যাসিসটেন্ট জুলহাজ সমকামী ও হিজড়া অধিকার বিষয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।

এর দুইদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে তার বাড়ির কাছে একই কায়দায় হত্যা করা হয়।

জুলহাজকে হত্যার নিন্দা জানিয়ে এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এ ঘটনার তদন্তে সহযোগিতারও প্রস্তাব দিয়েছেন।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বৈঠকে পুলিশের ভূমিকার ‘প্রশংসাই করেছেন’।

“উনি (বার্নিকাট) আপনাদের কী বলেছেন, আমি দেখিনি। কিন্তু তিনি আমার কাছে পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।”

সোমবার কলাবাগানে জোড়া খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “আপনারা জানেন, ঘটনার পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেই দিন পুলিশ একজনকে জাপটে ধরেছিল কিন্তু অন্য দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে আহত করে। পুলিশ ফায়ার ওপেন করেছিল। কিন্তু রাস্তায় মানুষ থাকায় দ্বিতীয় ফায়ার করতে পারেনি পুলিশ।

“উনি (বার্নিকাট) যেটা বলেছেন- তা আবেগের কথা বলেছেন। পুলিশ যথেষ্ট চেষ্টা করছে।”

বৈঠকে বার্নিকাট এসব হত্যায় আইএস এর মতো জঙ্গিদের জড়িত থাকার কথা বললেও তা মানতে রাজি হননি কামাল।  

তিনি বলেন, যেসব ঘটনা এখানে ঘটছে, সেগুলো ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গিদের কাজ। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব সন্ত্রাসীকে নির্মূলে কাজ করছে।

“আমরা (বার্নিকাটকে) বলেছি, সারা বিশ্বে খুন, হত্যা হচ্ছে। আপনাদের দেশেও হচ্ছে। দুইজন নিরীহ বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি বিষয়ে বার্নিকাট জোরালো করে কিছু বলেননি।

“তিনি বলেছেন তুমি আর তোমার সরকার সব সময় বলছ, আইএসের সাংগঠনিক শক্তি এখানে নেই। কিন্তু ঘটনা তো ঘটে যাচ্ছে।... আমরা বলেছি, এরা ‘হোমগ্রোন’ সন্ত্রাসী। আমাদেরকে অস্থিতিশীল করার জন্য ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে।”

আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আমরা বলেছি, আসুন আমরা একসাথে মোকাবেলা করি। কোনো ইনফরমেশন থাকলে আমাদের দিন, পুলিশের যে ইউনিটগুলো আমাদের আছে, সেগুলোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন।”      

তথ্য বিনিময়ের এই অনুরোধ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ‘সাদরে গ্রহণ করেছেন’ বলেও সাংবাদিকদের জানান মন্ত্রী।   

“আমরা তাকে বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কালকে (মঙ্গলবার) আমাদের ডেকেছিলেন এবং দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, কি করতে হবে, সেগুলো আমরা করব। আমাদের ইনটেলিজেন্স শেয়ারিং, যার কাছে যা আছে, তা যেন সব সময় শেয়ারিং হয় এবং অপরাধীদের তৎপরতা, অবস্থান- যাতে সব সময় সামনে থাকে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। সেটা আমরা জানিয়েছি তাকে।

“শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যেটা কথা হয়েছে, তা হলো সব কিছু শেয়ার করব, সবকিছু করতে চাই টু রেজিস্ট দিস টাইপ অব টেরোরিস্টস।”

বিষয়টি দেখভালের জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ মতো মন্ত্রণালয়ের  একজন অতিরিক্ত সচিবকে (রাজনৈতিক) ফোকাল পয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিষয়ে একটি ‘সেল’ও গঠন করা হবে বলে জানান মন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আর কী কী নির্দেশনা দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা প্রতি মাসেই সভা করি। উনি নির্দেশ দিয়েছেন সবাইকে, যত উইং আছে, একসঙ্গে কাজ করতে। টেরোরিস্টদের মোকাবেলায় করণীয় কী হবে, সেগুলো আলাপ হয়েছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইসহ অন্যান্য দেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সরকারকে কঠোর বার্তা দেওয়ার আহ্বান

‘ভিন্ন মতের’ মানুষদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে খুনিদের কঠোর বার্তা দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্শা বার্নিকাট।

বুধবার সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “তাদের (বাংলাদেশ সরকার) বিবৃতিতে এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, তুমি যাই বল না কেন, যাই লেখ না কেন, যে ঈশ্বরের উপাসনাই কর না কেন অথবা কোনো ঈশ্বরের উপাসনাই করবে না বলে পছন্দ করেছ, তুমি যাকেই ভালবাসবে বলে ঠিক কর না কেন- এসব কারণে তোমার খুন হওয়া বা নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কখনও বৈধতা দেওয়া হবে না।”

রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, তারা গত চার মাসে একই ধরনের ৩৫টি হামলার ঘটনা চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে ২৩টিতে আল কায়দা বা আইএস দায় স্বীকার করেছে।

হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের মাঝে তারা ‘ভয়’ ঢুকিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখানে যা ঘটছে (ভিন্ন মতের কারণে হত্যা) তা আদৌ বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নয়।

“আমি আপনাদের বলতে পারি, এই হামলাকারীরা যারা তাদের আদর্শে বিশ্বাস করে না এমন যে কারও দিকে নৃশংসভাবে এগিয়ে যেতে পারে। তাদের উগ্র আদর্শ এখানকার মানুষের মাঝে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।”

একই সঙ্গে বাংলাদেশের ‘সহিষ্ণুতা ও মুক্ত মতের দীর্ঘ ঐতিহ্যের’ প্রসঙ্গেও বলেন মার্শা বার্নিকাট।

অতীতে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেন রাষ্ট্রদূত।

“নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বলেন সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম ও সীমানা নেই। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে সরকার।”