পুরান ঢাকার একটি ব্যস্ত সড়কে তিন-চার জন যুবক এসে অনেকের সামনেই কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করে যায় অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে।
Published : 08 Apr 2016, 01:48 AM
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের ময়নাতদন্ত ইতোমধ্যে হয়েছে। প্রতিবেদন না এলেও মর্গের কর্মীরা জানিয়েছেন, তার মাথার এক পাশে গুলি এবং অন্য পাশে কোপের চিহ্ন রয়েছে।
সিলেটের বাসিন্দা নাজিমুদ্দিনের লাশ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তার স্বজনরা। এর আগে সতীর্থ হত্যার বিচার দাবিতে দিনভর বিক্ষোভ চলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।
পুরান ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এই শিক্ষার্থী গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটি বাসায় এক বন্ধুর সঙ্গে থাকতেন।
বুধবার রাত পৌনে ৯টার দিকে সূত্রাপুর থানা এলাকার ইকরামপুর মোড়ে হৃষিকেশ দাস রোডে নাজিমুদ্দিন আক্রান্ত হন বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।
এই স্থানটি লক্ষ্মীবাজারের সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রধান ফটক থেকে দেড়শ গজ দূরে। একরামপুরের মোড়ে সেখানে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে; সেই স্থানের বামের রাস্তা ধরে ধোলাই খাল যাওয়া যায়, আর ডানের রাস্তা ধরে যাওয়া যায় শ্যামবাজারের দিকে। ডানের রাস্তা ধরে ২০০ গজ সামনে সূত্রাপুর থানা।
হত্যাকাণ্ডের একদিন বাদে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়,অসংখ্য মানুষের চলাচল। হৃষিকেশ দাস রোড দিয়ে ৫ মিনিট পরপরই সদরঘাট-পোস্তগোলা রুটের লেগুনা আসা যাওয়া করছে।
একরামপুর মোড়ের সুর্বণা টেইলাসের সামনে সড়কের পাশে ড্রেনের কাছে রক্তের ছাপ। সেখানে আশপাশে অনেক দোকান এবং সেগুলোর অধিকাংশই নাজিম হত্যাকাণ্ডের সময় খোলা ছিল বলে স্থানীয়রা জানান।
সুবর্ণা টেইলার্সটিও খোলা ছিল, তার পাশের এস আর হেয়ার ড্রেসারও খোলা ছিল। খোলা ছিল রাস্তার বিপরীত পাশের হাবিব ফার্মেসি ও মহান চাঁদ সুইটসও।
তবে এসব দোকানের মালিক বা কর্মীদের কাছে ঘটনা জানতে চাইলে বেশিরভাগই চুপ মেরে যান। অনেকে বলেন, ওই সময়টায় তিনি দোকানে ছিলেন না। কে ছিলেন- জানতে উত্তর আসে, “সে এখন দোকানে নাই।”
নাম প্রকাশ করা হবে না বলে অভয় দেওয়ার পর সুবর্ণা টেইলার্সের এক কর্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাত পৌনে ৯টার দিকে আমাদের দোকানে ওঠার সিঁড়িতেই কয়েক যুবক মিলে এক যুবককে মারতে থাকে। একটু পরই গুলির শব্দ শুনি। কিছু বোঝার আগেই ওই যুবকরা দ্রুত চলে যায়।”
ওই যুবকরা কতজন ছিল, তারা কীভাবে এসেছিল- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তারা ছিল ৩/৪ জন। হেঁটেই এসেছিল।”
লক্ষ্মীবাজারের রোড ধরে নাজিম হেঁটেই আসছিলেন বলে জানান এই প্রত্যক্ষদর্শী।
তিনি বলেন, মারামারি দেখে ও গুলির শব্দে শুনে আশপাশের দোকানগুলো মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটনাস্থলে রাস্তার উপর সিটি করপোরেশনের একটি বৈদ্যুতিক বাতি রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতেও ওই বাতিটি জ্বলতে দেখা যায়।
আশপাশে বড় বড় ভবনগুলোতে হলেও ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) দেখা যায়নি। তবে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনের স্বপ্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে একটি সিটি ক্যামেরা রয়েছে।
সূত্রাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেসব ভবনের সিসি ক্যামেরা পাই, তার ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখব।”
একরামপুরের মোড় থেকে তিন দিকে যাওয়ার পথ থাকায় দুর্বৃত্তরা ওই স্থানটি বেছে নেয় বলে ধারণা করছেন তিনি।
অনলাইনে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন নাজিম। সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ছিলেন তিনি। হেফাজতের আন্দোলনের সময় ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ যে কথিত তালিকা কয়েকটি গণমাধ্যমে এসেছিল, তাতে তার নামও ছিল।
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বলছিলেন, এমন কয়েকজনকে গত বছর হত্যা করা হয়। ঘরে কিংবা তাদের হত্যাকাণ্ডেও মূলত চাপাতিই ব্যবহার করা হয়েছিল এবং হামলাকারীরা এসেছিল হেঁটে।
এর পাশাপাশি গত বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন দুজন বিদেশি এবং কয়েকজন ধর্মযাজকরাও। এসব হত্যাকাণ্ডে আবার হামলাকারীদের মোটর সাইকেলে আসতে দেখা গেছে।
এসব হত্যাকাণ্ডেই জঙ্গিদের কাজ বলে সন্দেহ পুলিশের। তবে শুধু তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে নাজিমের মতোই অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডস্থল থেকে দুজনকে ধাওয়া করে ধরেছিল জনতা।
নাজিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত ৫/৬ জনকে আসামি করে সূত্রাপুরের এসআই নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন বলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সমীর চন্দ্র সূত্রধর জানান।
লেখালেখির কারণেই কী এই খুন- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “ঘটনার পর থেকে তার (নাজিমুদ্দিন) ফেইসবুকে লেখা প্রায় সবই পড়েছি। কিন্তু কোথাও ধর্মীয় উস্কানির মতো বাক্য খুঁজে পাইনি।”
নাজিমুদ্দিন যেখানে থাকতেন সেই গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী ঘোষ লেনের বাসায়ও গিয়েছে পুলিশ। তার সঙ্গেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বিভাগে অধ্যরনরত সোহেলের সঙ্গেও কথা বলেছে পুলিশ।
ডিএমপির ওয়ারি জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার নূরুল আমীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোহেলের সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি সহযোগিতা করছেন তদন্তে।”
ছয়তলার ওই ফ্ল্যাটের দারোয়ান আব্দুল কাদের জানান, সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হতেন নাজিম, ফিরতেন রাত ৮/৯টার দিকে।