বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের ‘ফুলকুঁড়ি’ অভিহিত করে তাদের কল্যাণে ‘যা যা দরকার’ সব করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 15 Oct 2015, 01:43 PM
প্রথম সরকারপ্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় পৌঁছে বৃহস্পতিবার সেখানে বিদ্যুৎ সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনাদের সার্বিক কল্যাণে যা যা করণীয়, আওয়ামী লীগ সরকার তা করবে। দুঃখের রজনী শেষ হয়েছে, নতুন সূর্যালোকে আলোকিত হয়ে আলোর পথের যে যাত্রা আপনারা শুরু করেছেন সে যাত্রা অব্যাহত থাক।”
সকালে হেলিকপ্টারে করে ফুলবাড়ী পৌঁছান শেখ হাসিনা। পরে সেখান থেকে ১১টার দিকে গাড়িতে করে পৌঁছান দাসিয়ারছড়ায়।
কালিহাট গার্লস হাই স্কুল মাঠে সভামঞ্চ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি কয়েকজন বাসিন্দার মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বিতরণ করেন তিনি।
স্থানীয়দের নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, “দাসিয়ারছড়া এখন ছিটমহল নয়, এটি বাংলাদেশের অন্তর্গত ফুলবাড়ির এলাকা। আমি ফুলবাড়িতে এসেছি। ফুলবাড়ি এখন নতুন প্রস্ফূটিত ফুলের এক বাগান। এখানকার নাগরিকরা এখন এক একজন ফুল।”
“কোথায় যাব? কোনো ঠিকানা আপনাদের ছিল না। আজ আপনাদের সে অসুবিধা আর নাই। আপনারা এখন বাংলাদেশের সন্তান, এদেশের নাগরিক, বাংলাদেশেরই আপনজন।”
বিলুপ্ত ছিটবাসীদের বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা এবং চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান সরকার প্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ভারত থেকে যে ছিটমহলগুলো পেয়েছে সেগুলোতে ইতোমধ্যেই পাঁচটি অস্থায়ী পুলিশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার পরিবারকে বিদ্যুৎ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
ছিটমহলগুলোতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মসজিদ-মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র, রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘদিনের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কর্মসংস্থানের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, ভূমিহীন ও অতি দরিদ্রদের ঘড়বাড়িও নির্মাণ করে দেওয়া হবে।
বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সহায়তার জন্য ঋণ বিতরণ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।
ছিটমহলবাসীর জন্য এসব কর্মসূচির গ্রহণের কারণ ব্যাখ্যায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যাতে করে এই যে দীর্ঘদিন বঞ্চনা নিয়ে ছিলেন, সেই বঞ্চনা যেন আর না থাকে। আপনারা আমাদেরই একজন, আমাদেরই আপনজন। কাজেই আমরা দায়িত্ব নিয়ে আপনাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
“অনেক সময় চলে গেছে। কিন্তু এই যে এতদিনের বঞ্চনা সেটা কিভাবে পূরণ করা যায় আমরা সেজন্য অত্যন্ত আন্তরিক। আর সেকারণেই আজকে আপনাদের মাঝে ছুটে এসেছি।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা ভুল করেও নিজেদের ছিটবাসী মনে করবেন না। এ কথা চিন্তাও করবেন না। আপনারা এখন এদেশের নাগরিক, এটাই মনে করবেন।”
নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ৩১ জুলাই মধ্যরাতে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি সরকারি সেবার অধিকারপ্রাপ্ত হয় ছিটবাসী।
৩৭ হাজার বাসিন্দাসহ নিজেদের সীমানায় ভারতের এ ধরনের ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে বাংলাদেশ। একইভাবে ১৪ হাজার বাসিন্দাসহ ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল পেয়েছে প্রতিবেশী দেশটি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার সময় মুজিব-ইন্দিরা মৈত্রী চুক্তি ও স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়। ১৯৭৪ সালেই স্থল সীমান্ত চুক্তি সংসদে পাস করেন বঙ্গবন্ধু। তবে ভারত তাদের পার্লামেন্টে এটা করতে পারেনি। তারপরে পাস করতে করতে লাগলো ৬৮ বছর।”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে যারা সরকার গঠন করেছিল তারা এই চুক্তি বাস্তবায়নে কোনও কাজ করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
“জিয়া ক্ষমতায় আসে, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসে, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসে; কিন্তু কেউ এই চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের জন্য ভারতের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনা করতে হবে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করে নাই বা করবার মত মনে হয় সাহসও পায়নি।”
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ আলোচনা শুরু করলেও তখন পাঁচ বছরের মধ্যে ‘সমস্ত কাজ সম্পন্ন’ করতে পারেননি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকারে এসে আবার সেই কাজে তিনি হাত দেন।
স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য ভারতের পার্লামেন্টের সকল সদস্য ও নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যের সরকারগুলোকেও ধন্যবাদ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
এসময় ছিটমহলবাসীর জন্য নেওয়া নানা উন্নয়ন কর্মসূচির কথাও প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন।
তিনি জানান, ছিটমহলগুলোতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মসজিদ-মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র, রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে।
দীর্ঘদিনের সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পাশাপাশি ভূমিহীন ও অতি-দরিদ্রদের জন্য ঘড়বাড়ি নির্মাণ ও ঋণদান কর্মসূচির কথাও শেখ হাসিনা বলেন।
“অনেক সময় চলে গেছে। কিন্তু এই যে এতদিনের বঞ্চনা সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, আমরা সেজন্য অত্যন্ত আন্তরিক। আর সে কারণেই আজ আপনাদের মাঝে ছুটে এসেছি।”
সারা দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “ইনশাল্লাহ, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা প্রতি ঘরে ঘরে আলো জ্বালাতে পারব। শুধু বিদ্যুতের আলো নয়, শিক্ষার আলো জ্বালানো, স্বাস্থ্য সেবা দিব।”
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সরকারের লক্ষ্যের কথা এই অনুষ্ঠানেও বলেন তিনি।
সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে তার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিরোধদলীয় প্রধান হুইফ তাজুল ইসলাম, মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা হৈমন্তী শুক্লাসহ অন্যরা বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী দাসিয়ারছড়া থেকে ফিরে বেলা আড়াইটায় কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসভায় বক্তব্য দেন। সেখানে কুড়িগ্রাম জেলায় ১৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ১৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সদর উপজেলার ত্রিমোহনী এলাকায় নির্মিত সমন্বিত বীজ হিমাগার, রাজারহাট কৃষি-আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সেন্টার, কুড়িগ্রাম টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, রাজীবপুর ও নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নবনির্মিত ৫০ শয্যার হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প রয়েছে।