প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে মামলা, ফেইসবুকে নিন্দার ঝড়

ফেইসবুকে লিখে মন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ণের অভিযোগে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা হওয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সেই ফেইসবুকেই। 

স্যোশাল মিডিয়া ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2015, 08:45 AM
Updated : 17 August 2015, 12:41 PM

পুলিশ ও সরকারের এ ধরনের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বহু ফেইসবুক ব্যবহারকারী। সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই।    

যাদের ‘বুদ্ধি-পরামর্শে’ পুলিশ প্রবীর সিকদারকে ‘হয়রানি’ করছে, তাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকাকে সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন।

প্রবীরের পক্ষে যারা ফেইসবুকে সরব হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার।     

ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট অমি রহমান পিয়াল সোমবার ফেইসবুকে লিখেছেন “মুক্তিযুদ্ধে এতগুলো স্বজন হারিয়েছেন, স্বাধীন দেশে চলাচলের পা হারিয়েছেন। নীতি এবং বিবেক হারাননি প্রবীর সিকদার। হারাননি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার অদম্য মনোবল। হারাননি লড়ে যাওয়ার স্পৃহা। এমন যোদ্ধাকে হারাতে হলে মিত্রের বেশেই তো পিঠে ছুরি মারতে হবে...”

ফেইসবুকে লেখালেখির কারণে গত কিছু দিন ধরে হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন প্রবীর সিকদার। কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি বলে ফেইসবুকে এক লেখায় তিনি জানিয়েছিলেন।

২০১৪ সালে বেইজিংয়ে প্রবীর সিকদার। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে তিনি চীনে গিয়েছিলেন।

এরপর গত ১০ অগাস্ট ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামের একটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন : ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে ড. মুসা বিন শমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিন জনের অনুসারী-সহযোগীরা।”

ওই লেখার কারণে রোববার সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিক প্রবীরকে তাদের কার্যালয়ে ধরে নেয়। তখন তাকে আটক না করার কথা বলা হলেও রাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরে। তখনই জানা যায়, ফেইসবুকে লেখার মাধ্যমে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সুনাম ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন জেলার এপিপি স্বপন পাল।

সোমবার সকালে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় নেওয়ার পর প্রবীর সিকদারকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বিকাল তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রবীর সিকদার বর্তমানে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এর আগে সমকাল ও কালের কণ্ঠে কাজ করেছিলেন।

২০০১ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকার সময় সন্ত্রাসীর হামলায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন প্রবীর। তার অভিযোগ, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লেখার কারণে মুসার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালায়।

দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তাধীন মুসা বিন শমসের প্রধানমন্ত্রীর ফুপাতো ভাই ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর)।

রোববার রাতে প্রবীরের আটকের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়।

প্রবাসী সাংবাদিক ফললুর বারী ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “রাজাকার মুসা বিন শমশেরের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন ফরিদপুরের সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সন্তান প্রবীর সিকদার। এই রাজাকারের শুধু টাকার প্রতাপ না, ক্ষমতারও প্রতাপ! কারণ সে শেখ সেলিমের বেয়াই। রাজাকার মুসা তখন গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে প্রবীর সিকদারকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। দ্রুত তাকে ঢাকা আনতে পারায় বাঁচানো গিয়েছিল। কিন্তু তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়। তখন সারাক্ষণ তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। শেখ হাসিনা তখনো ক্ষমতায়। তিনি প্রবীরকে সিঙ্গাপুর পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।”

এরপর বারী লিখেছেন, “কিন্তু শেখ সেলিমের বেয়াইকে গ্রেপ্তার করাননি! শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতায়। রাজাকার মুসার ক্ষমতা এখনো বেয়াই শেখ সেলিম! তাই প্রবীর আবার রাজাকার মুসার বিরুদ্ধে লিখেছেন তাই ডিবিতো ধরে নেবেই। নিরাপত্তার কথা বলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার ফোন সব কেড়ে নেয়া হয়েছে! শেখ হাসিনা কিছু করতে পারবেন? মনে হয় না। কারণ বাঁশের চেয়ে বড় কঞ্চির মতো রাজাকারের বেয়াই শেখ সেলিম যে প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে।”

মামলা হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ফললুর বারী লিখেছেন, “স্বপন পাল নামের একজনকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছে! এর পিছনে প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন! প্রধানমন্ত্রীর দেয়া টাকায় সিঙ্গাপুর থেকে নকল পা লাগিয়ে এসেছিলেন প্রবীর! সেই এক পা ওয়ালা প্রবীরকে ধরে নিয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর পুলিশ! কোথায় যাচ্ছে আমার বাংলাদেশ?”

আতিকুর রহমান দর্জি নামে আরেকজন লিখেছেন, “....ছোট মুখে একটি বড়ো কথা বলি, সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের কিছুই হবে না....! ....চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর কিংবা গুলি করার পরও যেহেতু মারা যায় নাই, পুলিশি ভয় দেখিয়ে তার কিছুই করা যাবে না....!!! ....যাদের বুদ্ধি পরামর্শে প্রবীরসিকদারকে হয়রানি করা হচ্ছে তারা শেখ হাসিনার শত্রু, তারা আওয়ামী লীগের শত্রু....!!!”

আতিক বলছেন, প্রবীরকে যতো ‘হয়রানি করা হবে’ মানুষ ততো জানবে যে মুসা বিন শমসের সম্পর্কে শেখ সেলিমের বেয়াই।

“পচানোর এই আয়োজন যারা করেছেন তারা সহজে পার পাবেন বলে মনে হয় না....! .....রাজাকারের সমর্থনের চেয়ে প্রবীর সিকদারের পাশে দাঁড়ানোটাই শ্রেয় মনে করে এই দেশের জনগণ....!!! .....খুব দ্রুত থেমে যাওয়া উচিত....!!! প্রবীর সিকদারকে তার জায়গায় ফেরত দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে.....!”

সম্প্রতি অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক লেখায় মুসা বিন শমসেরকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ নিয়ে নিজের ফেইসবুক পাতায় সমালোচনায় মুখর হন প্রবীর। এরপর তিনি জনকণ্ঠে প্রকাশিত মুসাকে নিয়ে তার লেখা তুলতে থাকেন।

গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মুসাকে নিয়ে ‘জেনে নিন কে এই 'প্রিন্স ড. মুসা বিন শমসের'!’ লেখাটি নিজের ফেইসবুক পাতায় তোলেন প্রবীর, সেই সঙ্গে লেখেন-  “যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ছে ! রেহাই নেই কারও !”

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা বিন শমসেরের বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার, যার পরিবারের ১৪ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

তখন হামলার পর মামলায় মুসাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন প্রবীর, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

ব্লগার আজম খান (মহামান্য কহেন) তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, “নুলা রাজাকার ওরফে প্রিন্স মুসা বিন শমসের একজন কুখ্যাত রাজাকার। সে যার বেয়াই হোক, যার বাপ হোক, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। অনতিবিলম্বে তার বিরুদ্ধে প্রবীর সিকদারের খুঁড়ে আনা সকল তথ্য উপাত্ত, প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। অভিযোগ প্রমানিত হলে কোন খায় খাতির না করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক। কারো বেয়াই বলে কোন রাজাকার পার পেয়ে যাবে এই বাংলায়, তা হবে না, তা হবে না।”

মুসা বিন শমসেরের ‘যুদ্ধাপরাধের’ শাস্তির দাবিতে ফেইসবুকে একটি ইভেন্টও খোলা হয়েছে।

আলামিন তালুকদার লিখেছেন, “কতিপয় নষ্টলোকের বিবেক ও আদর্শবিচ্যুতি সমালোচনার সর্বনিকৃষ্ট স্তরকেও হার মানাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইসিটি আইন তো দেখছি বাংলাদেশ থেকে পূর্বপাকিস্তানের দিকে বহমান। জাতির পিতার আদর্শ ও সোনার বাংলার স্বপ্ন ভালো মানুষের প্রতিবাদহীনতা ও মন্দলোকদের নষ্টামীতে আজ বিলুপ্তপ্রায়।”

প্রবাসী সাংবাদিক ফললুর বারী আরেক পোস্টে লিখেছেন, “...ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের সম্প্রতি প্রমোশন হয়েছে। প্রমোশনের পর তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন!

“এখন প্রশ্ন, দিনে দিনে এত বেপরোয়া কেন এই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ? একটি সূত্রের মতে, তিনি নাকি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেন প্রধানমন্ত্রীকে। তার ঘরে প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে!”