মুসা শমসের নিয়ে স্ট্যাটাস, সাংবাদিক আটক

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী বলে অভিযুক্ত বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে লেখার পর গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে এক সাংবাদিককে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2015, 05:44 PM
Updated : 17 August 2015, 02:15 PM

প্রবীর সিকদার নামের এই সাংবাদিক ২০০১ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকার সময় সন্ত্রাসীর হামলায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন।

তার অভিযোগ, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লেখার কারণে মুসার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালায়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তাধীন মুসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর)।

সাম্প্রতিক স্ট্যাটাসে প্রবীর সিকদার প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই স্থানীয় সরকারমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়েও লিখেছিলেন, যে লেখায় নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। 

একাত্তরে শহীদের সন্তান প্রবীর সিকদার বর্তমানে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এর আগে সমকাল ও কালের কণ্ঠে কাজ করেছিলেন।

সম্প্রতি অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক লেখায় মুসা বিন শমসেরকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করার পর নিজের ফেইসবুক পাতায় সমালোচনামুখর হন প্রবীর। এরপর তিনি মুসাকে নিয়ে জনকণ্ঠে প্রকাশিত তার লেখা ফেইসবুকে তুলতে থাকেন।

রোববার গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মুসাকে নিয়ে ‘জেনে নিন কে এই 'প্রিন্স ড. মুসা বিন শমসের'!’ লেখাটি নিজের ফেইসবুক পাতায় তোলেন প্রবীর, সেই সঙ্গে লেখেন-  “যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ছে! রেহাই নেই কারও!”

এরপর রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর ইন্দিরা রোডের কার্যালয় থেকে প্রবীরকে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে তার ছেলে সুপ্রিয় সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

সুপ্রিয় বলেন, “প্রথমে একটি নীল রঙের পুলিশ ভ্যানে তাকে তোলা হয়েছিল। এরপর খামারবাড়ি এলাকায় ভ্যান থামিয়ে তাকে ধূসর রঙের একটি প্রাইভেটকারে তুলে গোয়েন্দা পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।”

সাংবাদিক প্রবীর সিকদার

বাবাকে তুলে নেওয়ার পর মোটর সাইকেলে পিছু নিয়েছিলেন সুপ্রিয়।

রাতে প্রবীরের মোবাইল থেকে ফোন পেয়ে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন তার ছোট ভাই, স্ত্রী ও দুই ছেলে।

সুপ্রিয় বলেন, “ডিবির এক এডিসি আমাকে বলেছেন, বাবাকে রাতে এখানে থাকতে হবে। কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘আমার হাত-পা বাঁধা’।”

তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রবীর সিকদারকে কোনো কারণে আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়নি।”

“তিনি তার জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন এবং পুলিশ তাকে সহায়তা করছে না এমন একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ডেকে আনা হয়েছে। পুলিশ তার কাছে জানতে চাইছে, কী কারণে তার জীবন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।”

মুসাকে নিয়ে সাম্প্রতিক লেখালেখির পর হুমকি পাওয়ার অভিযোগ এনে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন প্রবীর, তবে পুলিশ তা নেয়নি বলে ফেইসবুকে লিখেছেন তিনি।

প্রাণহানির শঙ্কা প্রকাশ করে প্রবীর সিকদারের ফেইসবুক স্ট্যাটাস

এরপর গত ১০ অগাস্ট ‘আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামের একটি স্ট্যাটাস দেন প্রবীর। তাতে তিনি লিখেন- “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন : ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে ড. মুসা বিন শমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিন জনের অনুসারী-সহযোগীরা।”

প্রবীর সিকদারের ছোট ভাই পীযূষ সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গোয়েন্দা পুলিশের এক এডিসি আমাদের জানিয়েছেন, উপর মহলের নির্দেশে দাদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তারা। দাদা ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, তিনজনের কারণে তার জীবন ঝুঁকিতে আছে। রাতে তার যদি কোনো ধরনের সমস্যা হয়….তাই তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে থাকতে হচ্ছে বলেও ওই এডিসি জানিয়েছেন।”

সোমবার সকাল ১০টার পর থেকে গোয়েন্দা পুলিশ প্রবীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলেও জানানো হয়েছে তার পরিবারকে।

“ওই কর্মকর্তা বলেছেন, টেনশন করবেন না, আমরা তার সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করব না,” বলেন পীযূষ।

তবে সেইসঙ্গে তিনি বলেন, “যিনি ক্র্যাচ ছাড়া বাথরুম ব্যবহার করতে পারেন না, তিনি কীভাবে সারারাত কাঠের চেয়ারে বসে থাকবেন?”

তবে মধ্য রাতে ডিবি কার্যালয় থেকে প্রবীর সিকদারকে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে বের হয় পুলিশ।

তার ছেলে সুপ্রিয় বলেন, তার বাবাকে ফরিদপুর নেওয়া হচ্ছে বলে তারা জেনেছেন। সেখানে তথ্য প্রযুক্তি আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছেন বলেও শুনেছেন তারা।

প্রবীর সিকদারের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফরিদপুরের এপিপি স্বপন পাল এই মামলা করেছেন বলে তা জেনেছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা বিন শমসেরের বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার, যার পরিবারের ১৪ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

তখন হামলার পর মামলায় মুসাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন প্রবীর, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

এরপর ঢাকায় চলে আসেন প্রবীর সিকদার। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে চীনেও গিয়েছিলেন তিনি।