এই ডাকাত দলকে ধরতে পুলিশকে সহায়তা করা পাঁচ ব্যক্তিকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়াসহ ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
Published : 27 Mar 2025, 02:49 PM
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে কোনো অভিযানে নামে, ঠিক সেভাবেই সজ্জিত হয়ে ঢাকার ধানমন্ডিতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে ডাকাতরা হানা দিয়েছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
২৫ থেকে ৩০ জনকে নিয়ে এই ডাকাত চক্র কাজ করে থাকে জানিয়ে পুলিশ বলছে, অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ম্যাজিস্ট্রেট, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী সেজে তারা ব্যবসায়ীর বাড়িতে ঢুকেছিলেন ডাকাতি করতে।
বুধবার ভোরের এই ঘটনার সময় ‘জনতার সহায়তায়’ ওই দলের চারজনকে ও রাতে আরও দুইজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের-ডিএমপি রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদ আলম।
গ্রেপ্তাররা ৬ জন হলেন- ফরহাদ বীন মোশারফ (৩৩), ইয়াছিন হাসান (২২), মোবাশ্বের আহাম্মেদ (২৩), ওয়াকিল মাহমুদ (২৬), আবদুল্লাহ (৩২) ও সুমন (২৯) ।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত র্যাব লেখা কালো রঙের দুটি জ্যাকেট, তিনটি কালো রঙের র্যাব লেখা ক্যাপ, একটি মাইক্রোবাস, পাঁচটি মোবাইল ফোন, একটি লোহার তৈরি ছেনি, একটি পুরাতন লাল রঙের স্লাই রেঞ্জ ও নগদ ৪৫ হাজার ১০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
এই ডাকাত দলটিকে ধরতে পুলিশকে সহায়তা করা পাঁচ ব্যক্তিকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়াসহ ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১ টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, “ওই সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রে ২৫-৩০ জন ছিল। অপারেশন পরিচালনার জন্য পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে ধরণের প্রিপারেশন নিয়ে যায়, সে ধরণের ফুল প্রিপারেশন তাদের ছিল। তাদের সাথে র্যাবের জ্যাকেট পরা অবস্থায় লোকজন ছিল। তারা মাইক্রোফোন হাতে মিডিয়ার লোক সেজে ছিল আর এই চক্রের যারা সোর্স হিসেবে কাজ করে, তাদের মধ্যে ৫ থেকে ৬ ছাত্র সেজে গিয়েছিল ছিল।”
বুধবার ভোরে ২০-২২ জন ডাকাতের একটি দল ধানমন্ডির আট নম্বর রোডে গয়নার দোকানের মালিক এম এ হান্নান আজাদের বাসায় ঢোকে। তাদের কয়েকজনের গায়ে ‘র্যাব’ লেখা জ্যাকেট ছিল। অন্যরা নিজেদের ম্যাজিস্ট্রেট এবং ছাত্র পরিচয় দেয়।
ধানমন্ডি থানার ওসি ক্যশৈনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, বাড়ির মালিকের সন্দেহ হলে তিনি জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেন।
"ফোন পেয়ে পুলিশ গিয়ে ওই বাসা ঘিরে ফেলে এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় চারজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।"
স্বর্ণ ব্যবসায়ী আজাদের বাসা থেকে দেড় লাখ টাকা এবং আড়াই ভরি সোনার গয়না ছাড়াও ওই ভবনে থাকা এস এম সোর্সিংয়ের অফিসের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ড্রয়ার থেকে ৩৫ লাখ টাকার বেশি লুট করে ডাকাতরা।
উপকমিশনার মাসুদ আলম জানিয়েছেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী এম এ হান্নান আজাদের ‘অলংকার নিকেতন জুয়েলার্স’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। তার বসুন্ধরায় দোকানের পাশাপাশি তাঁতীবাজারে কারখানা রয়েছে।
“বাড়িটির নিচতলায়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় এস এম সোর্সিংয়ের অফিস আছে। এ ছাড়া ওই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় একটি কনসালটেন্সি অফিস এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা নিয়ে ওই ব্যবসায়ীর ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট রয়েছে। ডাকাত দলটি তিনটি মাইক্রোবাস এবং একটি প্রাইভেটকারে ওই বাসার গেইটে নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে গিয়ে বলে, তারা র্যাবের লোক, তাদের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তারা বাড়িতে অভিযান চালাবে বলে তাড়াতাড়ি গেইট খুলতে বলে।
“সে সময় দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ড তাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। তখন অভিযুক্ত ডাকাতরা সিকিউরিটি গার্ডদের গালাগালি করতে থাকে এবং গেইট না খুললে তাদের হত্যার হুমকি দেয়। তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন গেইটের উপর দিয়ে উঠে জোর করে গেইট খুলে ফেলে। এরপর তারা সবাই জোর করে বাড়িতে ঢুকে সিকিউরিটি গার্ড, কেয়ারটেকার ও গাড়ি চালককে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।”
ব্যবসায়ীর বাসায় স্বর্ণ থাকতে পারে ধারণা করে ডাকাত দলটি আজাদের বাসা লক্ষ্য করে আসলেও তারা ভবনের নিচতলায় এস এম সোর্সিংয়ের অফিস থেকেই ‘তল্লাশির’ নামে লুটপাট শুরু করে বলেও জানিয়েছেন পুলিশের এই উপকমিশনার।
তিনি বলেন, “নিচতলার অফিসের গেইট ভেঙে পিয়নকে মারধর করে এবং হত্যার ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে ৪৫ হাজার ১০০ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এরপর ডাকাতরা তাকে ভয়তীতি দেখিয়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে এস এম সোর্সিংয়ের অফিসের গেইট ভেঙে ফেলে। এ সময় গেইট ভাঙার শব্দ পেয়ে চতুর্থ তলায় থাকা এস এম সোর্সিংয়ের তিনজন অফিস সহকারী তৃতীয় তলায় নেমে আসেন। ডাকাতরা তখন তাদেরও আটক করে মারধর করে অফিসের চাবি ও বাসার চাবি দিতে বলে।
"এরপর তারা চাবি নিয়ে তৃতীয় তলার অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে অফিসের ড্রয়ার ভেঙে নগদ ২২ লাখ টাকা লুট করে নেয় ও অফিসের বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। তাদের আরেকটি দল চতুর্থ তলার অফিসে ঢুকে আলমারি ভেঙে নগদ ১৩ লাখ টাকা লুট করে নেয়।”
'র্যাব ও ছাত্র' পরিচয় দিয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতি, গ্রেপ্তার ৪
সবশেষে ডাকাতের দলটি বাড়ির মালিক আজাদের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন উপকমিশনার মাসুদ আলম।
তিনি বলেন, “বাসা থেকে দেড়লাখ টাকা, স্বর্ণের কানের দুল ও চেইনসহ আনুমানিক আড়াই ভরি স্বর্ণ লুট করে নেয়। এরপর তারা মালিক আজাদবে জোর করে নিচে নামিয়ে গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করে।”
উপকমিশনার মাসুদ বলেছেন ডাকাতি চলার সময়েও কেউ একজন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন করে খবর দিলে নিকটস্থ পুলিশের টহল টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পুলিশ দেখে ডাকাত দলের লোকজন পালানোর চেষ্টা করে।
“এ সময় পুলিশের সঙ্গে ডাকাত দলের সদস্যদের হাতাহাতিও হয়, এতে পুলিশের দুই সদস্য আহত হন। তখন আশেপাশে থাকা লোকজনের সহায়তায় পুলিশ চারজনকে আটক করে। ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। পরে ওই ব্যবসায়ীর ভাগ্নে তৌহিদুল ইসলামের করা একটি মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।”
পরে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণ করে ও গ্রেপ্তার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি গাড়িসহ আরো দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলেও জানিয়েছেন উপকমিশনার মাসুদ।
বাকিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন “আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ছয় জনের বাইরে যারা আছে শিগগিরি আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করছি। তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে, রিমান্ডে এনে এসব তথ্য ক্রসচেক করব। যেহেতু ২৫-৩০ জনের মতো একটা টিম কাজ করেছে, তাই বাকিদের গ্রেপ্তারের সুবিধার্থে কিছু তথ্য আমরা পরে ডিসক্লোজ করতে চাচ্ছি।”
ওই দলে আইনশঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য জড়িত কী না অথবা তাদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় রয়েছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গ্রেপ্তার ছয়জনকে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবো।”
এ সময় ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “যাদের সহায়তায় ঘটনাস্থলে চার ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন পাঁচ জনকে আর্থিক পুরস্কার দেওয়াসহ ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।”
ঢাকাজুড়ে টহল ও তল্লাশিচৌকি ‘জোরদারের’ পরও এত বড় ডাকাতি কীভাবে হল-সাংবাদিক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রোজা ও ঈদকে ঘিরে আমাদের বিস্তারিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল কার্যক্রম জোরদার ও তল্লাশিচৌকি স্থাপন। দুই একটা ঘটনা যেগুলো ঘটছে সাথে সাথে ডিটেক্ট করছি। আমরা আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করছি, সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
এই ঘটনায় কেউ একজন ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে ‘বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন’ মন্তব্য করে ‘সন্দেহজনক’ ঘটনা চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে অবহিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।