জিজ্ঞাসাবাদে ছয় জঙ্গি স্বীকার করেছেন আফগানিস্তানের তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আল কায়েদা’ মতাদর্শে জঙ্গি সংগঠনের কাজ করছিলেন তারা।
Published : 11 Dec 2023, 01:46 PM
দেশের পাঁচ জেলায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলামের’ ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব; যারা ‘আল কায়েদা’ মতাদর্শে জঙ্গি সংগঠনের কাজ করে আসছিল অনেকদিন ধরে।
ঢাকার আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহে রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান।
গ্রেপ্তাররা হলেন-আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা (৪১), শরিফুল ইসলাম মুরাদ (৩১), আশিকুর রহমান ওরফে উসাইম্যান (২৭), মুহাম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবরার (২৪), মো. আল আমিন ওরফে সামুরা (২৪) ও মো. আবু জর মারুফ (১৮)।
এই ছয়জনের মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবাকে ‘আনসার আল ইসলামের’ আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক ও প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান বলছে র্যাব।
এই বাহিনীর ভাষ্য, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার জঙ্গিরা নিজেদের ‘আনসার আল ইসলাম’র সদস্য হিসেবে স্বীকার করে বলেছেন, তারা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এছাড়া আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়েও রাজ্জাক ‘কিছু তথ্য’ জানতেন।
সোমবার দুপুরে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “তারা সংগঠনের সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বই এবং উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতেন। এছাড়া সংগঠন চালাতে নিজেদের আত্মীয় স্বজনের কাছে মিথ্যা কথা বলে টাকাপয়সা নিতেন এবং দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার কাছ থেকেও নিয়মিত অর্থ নিতেন তারা।।“
এছাড়া গোপন সভার জন্য বিভিন্ন মসজিদ ও বাসাবাড়ি বেছে নিয়েছিলেন এই ছয়জন। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তির সঙ্গে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। এছাড়া সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও এই ছয়জন বিভিন্ন সময়ে করেছেন বলে জানান কমান্ডার মঈন।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গিদের অতীত কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়। আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি (রাজ্জাক) ২০১৫ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে 'আনসার আল ইসলামে' যোগ দেন।
সংগঠনে আসার পর রাজ্জাক বিভিন্ন পেশার আড়ালে সংগঠনের ‘দাওয়াতি’ কাজ শুরু করেন।
পরবর্তীতে রাজ্জাকের কাজের পরিসর বাড়ে। তিনি সংগঠনের রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রশিক্ষণ শাখার প্রধানের দায়িত্বে আসেন।
রাজ্জাকের সঙ্গে ‘আনসার আল ইসলামের’ বর্তমান আমির আবু ইমরানের 'সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে' দাবি করে কমান্ডার মঈন বলেছেন, “আমিরের নির্দেশেই রাজ্জাক আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের কাজ পরিচালনা করে আসছিলেন।“
রাজ্জাক জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য সংগ্রহে সোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়েছেন জানিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, “ তিনি সোশাল মিডিয়ার নানা মাধ্যমে তরুণদের ‘জঙ্গিবাদ ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ’ করার কাজ করতেন। এছাড়া সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে সংগঠনের শীর্ষ ও স্থানীয় অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন ও শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে কাজের নির্দেশনা নিতেন।“
এছাড়া রাজ্জাকের নির্দেশে সংগঠনের নতুন সদস্যদের গাজীপুর, টঙ্গি ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন আনসার হাউজে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হত।
র্যাব তাদের তদন্তে জেনেছে, রাজ্জাকের নির্দেশনাতেই গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি মুরাদ সংগঠনের বেশকিছু সদস্যকে তথাকথিত হিজরত ও বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পাশের কয়েকটি দেশে পাঠিয়েছিলেন।
তবে সংগঠনের সদস্যদেরই কেবল অন্য দেশে পাঠানো হয়নি, রাজ্জাকের নির্দেশনায় কয়েকটি দেশের ৪ জন সদস্য চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে এসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়।
মঈন বলেন, রাজ্জাক কাশিমপুর কারাগারে ‘আনসার আল ইসলামের’ বন্দি সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতেন এবং মাঝেমধ্যে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেখা করিয়ে দিতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তার জঙ্গি আশিকুর রহমান একজন হাফেজ, তিনি ময়মনসিংহ এলাকায় 'হিজামার' ব্যবসা করতেন বলে ভাষ্য কমান্ডার মঈনের।
তিনি জানান, আশিকুর ২০১৮ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০২০ সালে 'আনসার আল ইসলামে' যোগ দেন। তিনি প্রথমে দলের দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশ নেয়। পরবর্তীতে সংগঠনের ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম 'সেকশন চিফ' হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় আসেন আশিকুর।
এসবের পাশাপাশি আশিকুর সংগঠনের জিহাদী প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। নতুন সদস্যদের সংগঠন ও উগ্রবাদী পুস্তিকাও আশিকুর সরবরাহ করেছে।
এছাড়া সদস্যদের কারাতে প্রশিক্ষণ ও শারীরিক কসরতের ব্যবস্থা করা এবং প্রশিক্ষণকালীন সময় শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাজও করেছেন আশিকুর।
গ্রেপ্তার জঙ্গি মুহাম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবরার মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। ‘আনসার আল ইসলামে’ জাকারিয়া এই দলে ঢুকেছে ২০২০ সালে। ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কাজ শুরু করেন জাকারিয়া। এছাড়া আশুলিয়া, সাভার এবং মানিকগঞ্জ জেলার সংগঠনের সমন্বয়কের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।
জাকারিয়া কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্লাকবেল্টও হয়েছিল। পরবর্তীতে রাজ্জাকের নির্দেশে সংগঠনের সদস্যদের সাভার ও গাজীপুর, টঙ্গির বিভিন্ন 'আনসার হাউজে' কারাতে প্রশিক্ষণ দিত জাকারিয়া। জাকারিয়াও সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহের কাজও করেছে।
শরিফুল ইসলাম মুরাদ ‘আনসার আল ইসলামে’ এসেছে ২০১৮ সালে। এই জঙ্গি সদস্যও হাফিজিয়া মাদ্রাসা থেকে হেফজ সম্পন্ন করেছেন। প্রথমদিকে তারও কাজও ছিল সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে দাওয়াত দেওয়া।
পরে সংগঠনের আরও ৪জনসহ মুরাদ ২০১৯ সালের প্রথম দিকে তথাকথিত হিজরত ও জিহাদের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে যায়।
পরে ওই বছরের শেষের দিকে মুরাদ তার সঙ্গে লোকজনকে ওই দেশেই রেখে অবৈধ পথে বাংলাদেশে ফেরত আসে। দেশে ফিরে ‘দাওয়াতি’ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে মুরাদ।
গ্রেপ্তার জঙ্গি আল আমিন মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। ২০১৯ সালে ‘আনসার আল ইসলাম’র সঙ্গে জড়িত হন তিনি। পরবর্তীতে একটি মাদ্রাসার শিক্ষকতার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কাজ করেন আমিন।
পরে আমিন ২০২১ সালে ‘আনসার আল ইসলাম’র থেকে গড়ে ওঠা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র জন্য পার্বত্য এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের কাজ শুরু করেন।
‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন রাকিবের সাথে আমিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে আমিন স্বীকার করেছেন, রাকিবের নির্দেশে আমিন 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র কেনার জন্য নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেস। এছাড়াও তার সাথে কুকিচীনের নেতৃস্থানীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলেও জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তার সর্বকনিষ্ঠ জঙ্গি ১৮ বছর বয়সী আবু জর মারুফ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছেন। গতবছর জাকারিয়া তাকে দলে নিয়ে আসে। এবং জাকারিয়ার কাছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে ভ্রাম্যমান রকমারি ব্যবসার আড়ালে ‘দাওয়াতি’ কাজ করছিলেন মারুফ।