ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গির হদিস পুলিশ এক বছরেও বের করতে পারেনি। এদিকে জঙ্গি ছিনতাই মামলার প্রতিবেদন দিতে দফায় দফায় সময় নিচ্ছে সংস্থা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বলছেন, বড় ঘটনায় একটু বিলম্ব হতেই পারে, তবে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের ‘খুব কাছাকাছি’ রয়েছেন তারা।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি হলেন- মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) এই দুই আলোচিত জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
যেভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়
গত বছরের ২০ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধ আইনের এক মামলায় ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে অভিযোগ গঠনের (চার্জ শুনানি) শুনানির দিন ছিল।
মামলার ২০ আসামির মধ্যে দুইজন আসামি জামিনে। তারা আদালতে হাজির হন। ৬ আসামি ছিলেন আগে থেকেই পলাতক। অপর ১২ আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ওইদিন ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এরপর বেলা টার দিকে আসামিদের আদালত থেকে ঢাকার সিএমএম (মুখ্য মহানগর হাকিম) আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পুলিশ পাহারায়।
মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আসামাত্রই হাতকড়া পরা দুই জঙ্গি তাদের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশের এক সদস্যকে মারধর শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশে থাকা জঙ্গিদের সহযোগীরাও পুলিশের হামলায় যোগ দেন।
পুলিশের ওই সদস্যকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন কয়েকজন সহকর্মী। তাদের ওপরও হামলা চালিয়ে এবং পেপার স্প্রে ছিটিয়ে সিজেএম আদালতের প্রধান ফটকের উল্টো দিকের গলি দিয়ে মোটর সাইকেলে করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে নিয়ে পারিয়ে যায় সহযোগীরা।
মামলা
জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওই রাতেই ২০ জঙ্গিকে আসামি করে মামলা করেন আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন্দ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে সাগর ওরফে বড় ভাই ওরফে মেজর জিয়ার (চাকরিচ্যুত মেজর) পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় আয়মান ওরফে মশিউর রহমান (৩৭), সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে আকাশ ওরফে কনিক (২৪), তানভীর ওরফে সামশেদ মিয়া ওরফে
সাইফুল ওরফে তুষার বিশ্বাস (২৬), রিয়াজুল ইসলাম ওরফে রিয়াজ ওরফে সুমন (২৬) ও মো. ওমর ফারুক ওরফে নোমান ওরফে আলী ওরফে সাদ (২৮) পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে।
“এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুটি মোটরসাইকেল যোগে আনসার আল ইসলামের অজ্ঞাতনামা আরও ৫/৬ জন সদস্য অবস্থান নেয়। এছাড়া আদালতের আশপাশে ও মূল ফটকের সামনে অবস্থান করা অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য ছিল। এরপর তারা পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।”
বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
সংস্থাটি মামলার প্রতিবেদন দাখিলে এক বছরে ১১ দফা সময় নিয়েছে। সর্বশেষ ধার্য দিন ১৪ নভেম্বরেও প্রতিবেদন দিতে পারেনি সিটিটিসি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দার আদালত ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন দেন।
মামলার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ মামলায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই আসামি ও একজন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- শাহিন আলম ওরফে কামাল, শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিন, বি এম মজিবুর রহমান, সুমন হোসেন পাটোয়ারী, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল, মোজাম্মেল হোসেন সাইমন, আরাফাত রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ, আব্দুস সবুর ওরফে রাজু, রশিদুন্নবী ভূঁইয়া, মেহেদী হাসান অমি, ইদি আমিন, ফাতিমা তাসনিম শিখা, বখতিয়ার রহমান নাজমুল, হুসনা আক্তার হাসনা, খোদেজা আক্তার লিপি, তানভীর হোসেন, তানজিনা আফরোজ জাহান, নাসির মিয়া ও ওমর ফারুক তালুকদার।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে ধরতে ১৮/১৯ বার দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে জানিয়ে পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বলেন, “দুই জঙ্গি এখনো দেশের বাইরে যেতে পারেনি বলে আমাদের ধারণা। তারা আধুনিক ও তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত, প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। তারা হিট অ্যান্ড রান ভালোভাবে জানে। কোন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করলে কী হয়, জানে। তবে আমরা দুইজনকে গ্রেপ্তারের খুব কাছাকাছি রয়েছি।”
তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দফায় দফায় সময় নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক আজিজ আহমেদ বলেন, “বড় ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন তো একটু দেরি হবেই। মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। ওই দুই মূল আসামি ধরা পড়লেই আদালতে অভিযোগপত্র জমা পড়বে।”
তদন্তে বিলম্ব হওয়ার বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা আজিজ আহমেদের সুরেই কথা বলেছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইবুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারোয়ার খান জাকির।
“এ মামলায় অভিযোগপত্র জমা পড়লেই ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। তবে এতবড় ঘটনার তদন্তে একটু বেশি সময় লাগতেই পারে,” বলেন এই আইনজীবী।