এবারের শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও উঠে আসে।
Published : 14 Apr 2025, 12:03 PM
কারো হাতে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড, কেউবা আবার সেজেছেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী রূপে। দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজনও যোগ দিয়েছেন তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে।
নানা বর্ণ, রঙের মানুষের ঢল দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এবারও নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে বেরিয়েছে শোভাযাত্রা।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানসহ অনেকে অংশ নেন।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক ফেইসবুক পোস্টে বলেন, “এই ভূখণ্ডে নতুন বছর আসে কেবল বাঙালীর জন্য, এই উৎসব তাই কেবল বাঙালীর প্রাণের উৎসব’- এই বছর হতে এই ক্ষুদ্রতা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে এই প্রত্যয়ে অগণিত প্রাণের এই শোভাযাত্রা।
"চাকমা, মারমা, গারো, বাঙালীসহ ২৮টি জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের উচ্ছ্বাসে আজ মেতেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশ। বাংলাদেশের প্রাণের উৎসবে সবাইকে শুভেচ্ছা।"
বিগত বছরের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' এবার নাম বদলে হয়েছে 'আনন্দ শোভাযাত্রা'।
আয়োজন সংশ্লিষ্টরা নাম বদল না বলে একে নাম ‘পুনরুদ্ধার’ বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, “আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হত, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়’ ফিরে গেলাম। এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে।”
‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্যে বের হওয়া এবারের শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও উঠে আসে। দেওয়া হয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বার্তা।
‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ নামে একটি মোটিফ এবারের শোভাযাত্রার আগেই আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়।
গত শনিবার ভোরের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রার’ জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফ।
পরে একদিনের মধ্যেই 'ফ্যাসিবাদের প্রতিকৃতি' আবার নির্মাণ করে শোভাযাত্রার আয়োজন সংশ্লিষ্টরা। এই মোটিফটি ছিল শোভাযাত্রার সামনে। নতুন করে তৈরি করা এই ‘মোটিফের’ উচ্চতা ১৬ ফুট।
এবার শোভাযাত্রায় ৭টি বড় মোটিফ, ৭টি মাঝারি মোটিফ এবং ৭টি ছোট মোটিফ অংশ নেয়। এছাড়া ছোট, বড়, মাঝারি অসংখ্য শিল্পকর্ম দেখা যায় শোভাযাত্রায়।
শোভাযাত্রায় অংশ নেয় বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)। এছাড়া কৃষককে গুরুত্বপূর্ণ থিম হিসেবে শোভাযাত্রায় তুলে ধরা হয়। নবপ্রাণ আন্দোলনের তত্ত্বাবধানে সাধু ও বাউলদের অংশগ্রহণ, নারী ফুটবলারদের অংশগ্রহণও ছিল শোভাযাত্রায়।
অন্যান্য মোটিফের মধ্যে ছিল- তরমুজের ফালি, বাঘ, ইলিশ, শান্তির পায়রা ও পালকি। এছাড়া ৩৬ জুলাই টাইপোগ্রাফি আর পানির বোতলের মোটিফ মনে করিয়ে দেয় জুলাই আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের কথা।
শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তরমুজের ফালি রাখার কথা জানান আয়োজন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, “তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
“এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রঙ সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রঙ লাল, সাদা ও কালো। এ রঙগুলো ফিলিস্তিনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।"
অধ্যাপক আজহারুল বলেন, “এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সাথে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ রাখা হয়েছে।"
গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল; সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।
এবার নাম বদলে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ সকাল ৯টায় শুরু হয় চারুকলা অনুষদ থেকে। এর আগে সকাল ৮টা থেকে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলে।
শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।
আয়োজন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য লোক-ঐতিহ্য এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে আরও বড় পরিসরে ও বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে এবছর শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শোভাযাত্রায় এবছর ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিরা অংশ নেন।
নববর্ষ উপলক্ষ্যে নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপন করা হয়।