খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোটা বিশেক প্রকাশনা সংস্থা নিয়মিত লেখকদের রয়্যালটি দিলেও বাকিরা দেয় না। উল্টো ঘটনাও ঘটে।
Published : 23 Apr 2024, 10:34 PM
দেশে বছরে কত টাকার সৃজনশীল বই বিক্রি হয়, লেখকরা ঠিকমতো রয়্যালটি পাচ্ছেন কিনা, প্রকাশকও কী লাভের মুখ দেখছেন- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রীতিমত এক ‘গোলকধাঁধার চক্করে’ পড়তে হয়।
প্রতি বছরই দেখা যায়, একুশে বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এবছর বইমেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আগের বছর বইমেলায় অংশ নিয়েছিল ৬০১টি প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে এবার প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে ৩৪টি।
বইমেলা সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মনে করেন, বইয়ের ব্যবসায় যদি লোকসানই গুণতে হতো, তবে প্রতি বছর স্টলের সংখ্যা বাড়ত না। প্রকাশনা ব্যবসা যদি লাভজনকই হয়, তবে লেখকরা ঠিকমতো রয়্যালটি পাচ্ছেন তো? এমন প্রশ্ন অনেকেরই মনে।
দেশের প্রথম সারির অন্তত দশটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা কেউই বই বিক্রি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে নারাজ। এসব প্রকাশনা সংস্থা থেকে বই প্রকাশ করেছেন, এমন খ্যাতিমান ১০ জন লেখকের কাছে জানতে চাইলে তারাও বছরে কত টাকা রয়্যালটি পাচ্ছেন, তা জানাতে রাজি হননি।
২০২০ সালে একুশে বইমেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। মেলা শেষে বাংলা একাডেমির দেয়া তথ্যে বই বিক্রির এ হিসাব জানা যায়। এই টাকার ১৫ শতাংশ (ব্যতিক্রম ছাড়া) রয়্যালটি ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা হওয়ার কথা। সেই পরিমাণ টাকা লেখকরা পেয়েছিলেন কিনা, তা জানা সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালে মহামারীতে টালমাটাল অবস্থায় বইমেলায় বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার বই। ২০২২ সালে এই অংক ছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩ সালে ৪৭ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় ৬০ কোটি টাকার কেনাবেচার তথ্য দেয় মেলা পরিচালনা কমিটি।
ফলে কোভিড পরবর্তী সময়ে বইয়ের বিক্রি কমেছে বলে ধারণা দিচ্ছে বইমেলা কর্তৃপক্ষ। তবে বই বিপণন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কোভিডের পর অনলাইনে বই বিক্রি বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোটা বিশেক প্রকাশনা সংস্থা নিয়মিত লেখকদের রয়্যালটি দিলেও বাকিরা দেয় না। উল্টো লেখকরা প্রকাশনাগুলোকেই টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন।
চেইন বুকশপ, অনলাইন বিক্রেতা ও শীর্ষস্থানীয় একটি প্রকাশনা সংস্থা ‘বাতিঘর’ এর স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বইয়ের পাঠক আছে, তাদের অনেকে এখন অনলাইনে বই কিনছেন।”
রয়্যালটি প্রশ্নে দীপঙ্কর বলেন, “বাতিঘর লেখকদের নিয়মিতই রয়্যালটি দিচ্ছে। সাধারণত মার্চ টু ফেব্রুয়ারি হিসাব করে রয়্যালিটি দেয়া হয়। যাদের বই বেশি বিক্রি হয়, তারা বেশি টাকা পান।”
কত টাকা রয়্যালটি পান লেখক?
রয়্যালটি হচ্ছে বই বিক্রির আর্থিক লভ্যাংশ। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের চুক্তি উপর। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে লেখকের রয়্যালটি নির্ধারণ করা হয়।
কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে বই বিক্রি থেকে তিনি ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা রয়্যালটি পেয়েছেন। চলতি বছরের রয়্যালটি পাবেন ২০২৫ সালের মার্চ মাসে।
এছাড়া দেশের প্রথম সারির একটি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্ত্বাধিকারী জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে তারা ৪০ লাখ টাকা লেখক রয়্যালটি দিয়েছেন। আরেকটি প্রকাশনী সংস্থা জানিয়েছে, গেল বছর একজন লেখককেই তারা ১৫ লাখ টাকা রয়্যালটি দিয়েছেন। এই প্রকাশকরা নিজেদের পরিচয় জানাতে চাননি।
রয়্যালটির পুরো বিষয়টি লেখক-প্রকাশকের এক ধরনের সমঝোতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। লিখিত চুক্তি হলেও তা কেবল নামমাত্রই থাকে। মূলত যে লেখকদের বই বেশি বিক্রি হয়, তাদেরকেই রয়্যালটি দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো লেখককে অগ্রিম টাকাও দেওয়া হচ্ছে। তবে কী পরিমাণ টাকার লেনদেন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রকাশকরা কেউই প্রকাশ্যে বলতে নারাজ।
প্রকাশকরা মনে করেন, এর সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বই প্রকাশনা শিল্পের বিশেষ ছাড় ও প্রণোদনা পাওয়া উচিত বলে তাদের দাবি।
২০১৫ সালে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ বইটি বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এই বাতিঘর আর চেইন বুকশপ বাতিঘর একই প্রতিষ্ঠান নয়। লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন নিজেই এই প্রকাশনা সংস্থাটির স্বত্বাধিকারী। পরে কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স থেকে বইটির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে ভারতের খ্যাতিমান নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি এই বইটি থেকে একটি সিরিজ নির্মাণ করেন।
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নিজেই বইটির প্রকাশক। ফলে আমার রয়্যালটির বিষয়টি একটু আলাদা। ভারত থেকেও বইটি অনেক বিক্রি হয়েছে। সেখান থেকেও টাকা পেয়েছি।”
নাজিম উদ্দিনের দাবি, এই বইটি এক লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
তবে রয়্যালটির পরিমাণ জানাতে চাননি তিনি।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শাহাদুজ্জামান, সাদাত হোসেন, স্বকৃত নোমানসহ অন্তত ৫০ জনের বেশি লেখক আছেন, যারা নিয়মিত রয়্যালটি পাচ্ছেন। তবে তারা কত টাকা রয়্যালটি পাচ্ছেন, তা জানা সম্ভব হয়নি।
তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদ লেখাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
২০২৩ সালের বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইয়ের মধ্যে ছিল মহিউদ্দিন আহমদের ‘লাল সন্ত্রাস’ ও ‘প্রতিনায়ক’। সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টি এবং সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে লেখা বই দুটি পাঠকের মাঝে তুমুল আগ্রহ জাগায়।
এছাড়া এই লেখকের ‘৩২ নম্বর পাশের বাড়ি: ২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট’, ‘বেলা অবেলা’, ‘তেহাত্তরের নির্বাচন’, ‘চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ’, ‘আওয়ামী লীগ উথান পর্ব- ১৯৪৮-১৯৭০’, ‘আল কায়েদার খোঁজে’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’, ‘জাসদের উত্থান-পতন অস্থির সময়ের রাজনীতি’সহ বেশ কিছু বই পাঠকের কাছে সারা বছরই সমাদৃত হয়। মহিউদ্দিন আহমদের রাজনীতি বিষয়ক বইগুলোর বিক্রি বেশি হয়।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার প্রায় সব বই প্রথমা ও বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তারা প্রতি বছরই রয়্যালটির টাকা হিসাব করে আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়াও দু-একটি প্রকাশনীতে আমার বই আছে এবং প্রকাশ হবে। কেউ কেউ ১/২ হাজার কপি বিক্রির রয়্যালটি হিসাব করে অগ্রিম টাকা দিয়েছে।”
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক মনে করেন, বছরজুড়ে দেশে বইয়ের বাজার শত কোটি টাকার বেশি নয়।
তিনি বলেন, “বইমেলায় যদি ৫০/৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, তবে সারা বছর ওই পরিমাণের চেয়ে বেশি বিক্রি হয় না। সব মিলিয়ে বছরজুড়ে শত কোটি টাকার সৃজনশীল বই বিক্রি হয় বলে আমার ধারণা।”
আনিসুল হকের ভাষ্য, “যদি ১০০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, তাহলে ১৫ শতাংশ রয়্যালিটির হিসাবে ১৫ কোটি টাকা পাওয়ার কথা লেখকদের। সারা বছর অন্তত ৩ হাজারের বেশি লেখক বই প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে সেই টাকাটি যদি দেওয়া হয়, সেটি খুব বেশি টাকা নয়।”
রয়্যালটির টাকায় জীবিকা নির্বাহ সম্ভব?
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, লেখালেখিকে জীবিকা হিসেবে নিতে চাওয়াটা সহজ নয়।
“এখন জীবনকে কীভাবে যাপন করবে, সেটাও প্রত্যেকে নিজের মতো করেই ভাবে। কেউ যদি মনে করে মধ্যবিত্ত জীবনে থাকবে, তবে লেখালেখি করে সেটা সম্ভব। তবে কাজটি খুবই চ্যালেঞ্জিং।”
কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান মনে করেন, লেখকের খ্যাতিরও এক ধরণের আর্থিক মূল্য রয়েছে। বই লিখে কেউ যখন লেখক স্বীকৃতি পাচ্ছেন, তার ব্যক্তিজীবনে সেটি নানাভাবে ভূমিকা রাখছে এবং আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন।
তার ভাষ্য, “আমার তিনটি উপন্যাস খুব বেশি বিক্রি হয়নি। চতুর্থ উপন্যাস থেকে ভালো বিক্রি শুরু হয়েছে। এবারের মেলায়ও আমার বই ভালো বিক্রি হয়েছে। যখন থেকে আমার বই ভালো বিক্রি হচ্ছে, আমার কিন্তু সামাজিক মর্যাদাও বাড়ছে। বিভিন্ন টেলিভিশনে টক শো বা সেমিনারে আমন্ত্রণ পাচ্ছি। সেখানে কেউ কেউ আমাকে সম্মানি দিয়েই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এই যে তারা আমাকে সম্মানি দিয়ে সেমিনারে বা টক শোতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, সেটাও তো লেখক হিসেবেই উপার্জন বলে মনে করি।”
লেখালেখি করে যদি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করার চাপ থাকে, তখন লেখার মান নষ্ট হবে বলেও মনে করেন আনিসুল হক।
তিনি বলেন, “তখন তো বই লেখার জন্য ভাবতে হবে, পাঠক কী চায়? কোন বই বেশি বিক্রি হবে, বই বিক্রি না হলে তো টাকা আসবে না। এতে করে লেখার মান ঠিক থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
“বাংলাদেশে বই লিখে জীবিকা নির্বাহ করার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। আমি যেমন সাংবাদিকতা পেশার ফাঁকে লেখালেখি করি। জাফর ইকবাল স্যার শিক্ষকতায় যুক্ত। এ প্রজন্মের লেখকদের মাঝে সাদাত হোসেন আছেন, তিনিও অন্য পেশায় থেকে লেখালেখি করেন।”
মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মনে করেন, বাংলাদেশে বইয়ের বাজার অনেক বড়। কিন্তু সবার কাছে এখনো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
“আমাদের ভালো লেখার অভাব আছে। সেই সাথে ভালো লেখার মার্কেটিংয়েও জোর দিতে হবে। আমাদের সিনেমার দর্শকও অনেক আছে, বইয়ের পাঠকও অনেক আছে। দরকার ভালো লেখা এবং তা পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি সবাই কিন্তু আমাদের পাঠক। ভারত থেকে আমার বই প্রকাশ হয়েছে, আমি কিন্তু সেখান থেকেও টাকা পেয়েছি। সেটি রেমিট্যান্সও বলা যায়। ভারতে আমাদের বইয়ের বাজারের সম্ভাবনা আছে।”