টাইলস ও সব্জি রপ্তানির আড়ালে যুক্তরাজ্যে ২১ ও ৫৪ কেজি হেরোইন পাচারের অভিযোগে ২০০৫ সালে দায়ের করা হয়েছিল দুটি মামলা।
Published : 19 Apr 2024, 09:22 AM
ঘটনা প্রায় দুই দশক আগের, অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে- তাও এক দশক পেরিয়ে গেছে। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী আনতে না পারায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে বিডি ফুডসের বিরুদ্ধে হেরোইন পাচারের দুই মামলার বিচার।
টাইলস ও সব্জি রপ্তানির আড়ালে যুক্তরাজ্যে ২১ কেজি হেরোইন পাচারের অভিযোগে ২০০৫ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার এক আসামি ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে ৫৪ কেজি হোরোইন পাচারের অভিযোগে অন্য মামলাটি দায়ের করা হয় ঢাকার সূত্রাপুর থানায়।
মতিঝিল থানার মামলায় ছয় আসামির বিচার শুরু হয় ২০১৩ সালে। আর ২০১৪ সালে সূত্রাপুরের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়।
মতিঝিলের মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৮ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে। এ মামলার বাদী সিআইডি কর্মকর্তা দীপক গুপ্তের (বতর্মানে অবসরপ্রাপ্ত) সাক্ষ্য শেষ হয় ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর।
তারপর গত পাঁচ বছরে দফায় দফায় তারিখ দিয়েও ১৩ সাক্ষীর কাউকে আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও পুলিশ তাদের আদালতে আনতে পারেনি।
এ আদালতের বতর্মান বিচারক বদরুল আলম ভূঞা আগামী ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষে আবারো সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ রেখেছেন। কিন্তু মামলার কোনো খবর বলতে পারেননি এ আদালতের পেশকার ফজলুর রহমান বা সাঁটলিপিকার আব্দুর রহমান।
ফজলুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এত পুরানো মামলা, এত বড় হোরোইনের চালান, এ মামলা এতদিন ঝুলে থাকার কথা নয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছে মামলার নথির হদিস পাওয়া যায়।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এর আগের বিচারক শামীম আহাম্মেদ মামলার সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এক আদেশে তিনি বলেছিলেন, “ইহা দীর্ঘদিনের পুরনো মামলা, যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিচার ও নিষ্পত্তির দাবি রাখে।
প্রচলিত আইনের নিয়মে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের। কিন্তু জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের হাজির করতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। সে কারণে মামলাটির বিচার নিষ্পত্তিতে দীঘসূত্রতা ঘটছে বলে পর্যবেক্ষণ দেয় আদালত।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব কিছুই করা হচ্ছে, কিন্তু সাক্ষী হাজির করা যাচ্ছে না।”
মতিঝিল থানার এ মামলায় অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- বিডি ফুডসের কর্মচারী নাজমুল হায়দার ওরফে বুলবুল, ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক মিঠু, ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন, তাদের সহযোগী বিমানের কার্গো শ্রমিক মোখলেসুর রহমান নয়ন, আরেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার সেলিম, মিন্টু ওরফে তাজউদ্দিন।
তাদের মধ্যে মিন্টু পলাতক রয়েছেন, তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি হলেও পুলিশ ধরতে পারেনি।
বিশেষ জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নিজেও ফোনে অনেক সাক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা অনেকবার কথা দিয়েও আসেননি। অনেকে দেখছি বলে দায় এড়িয়ে গেছেন।”
এ মামলার সাক্ষীরা হলেন- লক্ষ্মীপুরের রসিকপুরের আমিনুল ইসলাম, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের মুসাপুরের লুৎফর রহমান, আমদানি অধিদপ্তরের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহ আলম, জামালপুরের বকশীগঞ্জের শেখেরচর এলাকার বাহাদুর আলী, ঢাকার তুরাগের কামারপাড়ার শাহ আলম, ঢাকার কালিরটেকের রহমত আলী, একই এলাকার আরমান, এরফান, মানিকগঞ্জের তাগজীনগরের বিপ্লব আহমেদ, পাবনার চাটমোহরের অবসরপ্রাপ্ত কাস্টম কর্মকর্তা বোনাফিস কেরাইয়া, ফেনীর পরশুরামের কাস্টমস কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ মহসীন, শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিপ্তরের উচ্চমান সহকারী সত্যেন হালদার এবং ঢাকার সাবেক মহানগর হাকিম ননী গোপাল বিশ্বাস।
কী ঘটেছিল?
২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যে পাঠানো বিডি ফুডসের দুটি চালানে ৭৫ কেজি হেরোইন ধরা পড়ার পর ওই কোম্পানির চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিনসহ আটজনকে আসামি করে ঢাকার মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে সিআইডি।
একটি চালানে ২১ কেজি হেরোইন পাচারের মামলাটি হয় মতিঝিল থানায়। আর সূত্রাপুর থানায় দায়ের করা হয় ৫৪ কেজি হেরোইন পাচারের মামলা।
মতিঝিলের মামলায় ২০১২ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ হোসেন।
সেখানে বলা হয়, চট্টগ্রাম নৌবন্দর দিয়ে শিম, লতাপাতা, কচু ও জালি ভরে ১৭০টি কার্টনে মোট সাত হাজার কেজি সবজির ভেতরে লুকিয়ে যুক্তরাজ্যে ২১ কেজি হেরোইন পাচার করে বিডি ফুডস।
চালানটি যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর পর সেদেশের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। যুক্তরাজ্য এ ঘটনা বাংলাদেশকে জানালে তৎপর হয় সরকার।
পরে এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিডি ফুডসের কর্মচারী নাজমুল হায়দার, ব্যবস্থাপক মাঈনুদ্দিন ও বিমানের কার্গো শাখার কর্মী নয়ন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, জবানবন্দিতে বিডি ফুডসের চেয়ারম্যানসহ অন্যদের নাম এলেও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই তিনজনের দেওয়া বক্তব্য ‘অসত্য’ বলে দাবি করেন মোমিন।
এ মামলায় দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ গঠনের শুনানি চলে। পরে বিডিফুডসের সত্ত্বাধিকারী বদরুদ্দোজা মমিন এবং সহযোগী কাজী জাফর রেজার অব্যাহতির আবেদন মঞ্জুর করে ২০১৩ সালের ৩ জুন বাকি ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ মামলায় আসামি নাজমুল হায়দার বুলবুল অব্যাহতি চেয়ে হাই কোর্টে গিয়েছিলেন। তার ওই আবেদন দেখে হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি রুল জারি করে।
মোমিন ও জাফর রেজার অব্যাহতির আদেশ কেন বেআইনি হবে না-তা জানতে চাওয়া হয় সেই রুলে। মমিনকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরে একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। কিন্তু পরে তার হাজিরার কোনো তথ্য আর আদালতের কর্মীরা জানেন না। হাই কোর্টের দেওয়া রুলটি এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
আইনজীবী আমির হোসেন বলেছিলেন, “বদরুদ্দোজার হাজিরা দেওয়া উচিৎ। কেন তিনি হাজিরা দিচ্ছেন না বলতে পারব না। হাই কোর্ট মামলাটিতে কোনো স্থগিতাদেশ দেয়নি।”
আলামত
সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যে আটক হওয়া হেরোইন আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের এ মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকায় লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে আলামতও সরবরাহ করছে না যুক্তরাজ্য সরকার।
এ মামলার আগের বিচারিক আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাহউদ্দিন হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আলামত ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক দেন দরবার হয়েছে। কিন্তু আলামত আনা যায়নি। যে কারণে মামলা বিচারের গুরুত্ব হারাচ্ছে বলে আমি মনে করছি।”
বাংলাদেশের আইনে এক কেজির বেশি হেরোইন পাচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যে কোনো অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করা হয় না।
২০০৮ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাজ্যের জেনারেল অ্যাটর্নি বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে এই মামলায় দোষীদের মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চাওয়া হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ।
৫৪ কেজি হেরোইনের মামলাও আটকে
মোমিনসহ আট আসামি বিরুদ্ধে ৫৪ কেজি হেরোইন পাচারের অন্য মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ মো. আলী হোসাইনের আদালতে।
এ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রফিক উদ্দীন বাচ্চু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের আদালতের মামলাটিতে বেশ কয়েকজন সাক্ষী এসেছিলেন। এখন আর আসছেন না। মামলাটি প্রমাণ করা কঠিন, কেননা লন্ডন থেকে আলামত সংগ্রহ করা যায়নি।”
২০১২ সালের ১ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন এই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সেখানেই এজাহারের আসামি বদরুদ্দোজা মোমিন ও মাঈনুদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।
বিডি ফুডসের কর্মচারী নাজমুল হায়দার ওরফে বুলবুল, ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক ওরফে মিঠু, আরেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার সেলিম, কাজী জাফর রেজা,মিন্টু ওরফে তাজউদ্দিন ও মো. আলতাফ হোসেন ভূঁইয়াকে আসামি করা হয় এ মামলার অভিযোগপত্রে।
২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. আখতারুজ্জামান অভিযোগপত্র গ্রহণ করলে মোমিন ও মাঈনুদ্দিন অব্যাহতি পান।
আদালত বদলের পর ২০১৪ সালের ২০ মে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পরে আরও দুইবার আদালত বদল হয়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল মামলাটি ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতে আসে। ওই আদালতে আরও ছয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। মামলায় মোট ২৪ জন সাক্ষী রয়েছে।
পুরনো খবর:
হেরোইন পাচার মামলায় প্রমাণ সংগ্রহ করতে যুক্তরাজ্য যাচ্ছে তদন্ত দল
বিডি ফুডসের হেরোইন পাচারের বিচার শুরু হয়নি ১১ বছরেও
সাক্ষী আসে না, আটকে আছে বিডি ফুডসের হেরোইন পাচারের এক মামলা