“সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর রয়েছে। সেখানে সবগুলো বিষয় আলোচনা করা হবে বলে আমি আশা রাখি।”
Published : 25 Jun 2024, 06:06 PM
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের আগে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন পক্ষের মতামত শুনে নিলেন সফররত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান লিউ জিয়ানচাও।
মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে ‘চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যত: সিপিসি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
সেখানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, কূটনীতিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ তাদের মতামত জানান।
সদ্য ভারত সফর শেষ করে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে চার দিনের সফরে চীন যাবেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এ সফরে ব্যবসা, বিনিয়োগসহ পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন তিনি।
ধারাবাহিকভাবে দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর সফর সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, চীন ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেমনই হোক, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের কাঠামো পৃথক।
“চীনের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে। চীন উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত রাষ্ট্র থেকে এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উন্নত রাষ্ট্র। আমাদের যেহেতু একটা উন্নয়নের ভিশন আছে, সেই দিক থেকে চীনের কাছ থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, শিক্ষা খাতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার বিষয়ে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। কারণ চীন প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষায় বিপ্লব করেছে। বাংলাদেশের দশটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প হতে পারে। ফ্রান্স ও জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে এই ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়।
“পাশাপাশি গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবায় একসাথে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ও চীনের কিছু ট্র্যাডিশনাল ওষুধের প্রচলন আছে। এগুলোকে আরও প্রমোট করা যায়।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, “সহযোগিতার প্রায় সব ক্ষেত্রেই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিদ্যমান। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ চীনের ওয়ান চায়না নীতি অনুসরণ করছে। এখন সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে।”
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের প্রসঙ্গ টেনে সাব্বির বলেন, “এই সফরে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা পদ্ধতির সংমিশ্রণ নিয়ে আলাপ হতে পারে। চীনের শিক্ষা পদ্ধতি এখন বিশ্বসেরা। চীনে উচ্চ শিক্ষা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্কলারশিপ নিয়েও যাচ্ছে আবার সেলফ ফাইন্যান্সিংয়েও যাচ্ছে। তবে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জনপ্রিয় করতে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
“দুই দেশ বিশাল জনসংখ্যার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ কম। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য আয়োজনের মাধ্যমে এই যোগাযোগ আরও বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। চীনেরও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে রয়েছে ব্যাপক সক্ষমতা। এই খাতে বাংলাদেশে চীনের কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।”
চীনকে ‘আগামী বিশ্বের নেতা’ হিসাবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন, বিশ্বে আগামী দিনে যে কোনো পরিবর্তন আনার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনীতিক দূরত্ব কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চীনের যে ভূমিকা, বাংলাদেশ সেটাকে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতেও চীনের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।”
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “আমার দল ও বাংলাদেশ এক চীন নীতির পক্ষে আছে। তাইওয়ান চীনের অংশ বলেই আমরা মনে করি। বর্তমান একমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা চীনের প্রচেষ্টায় বহুমুখী বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরিকরণে চীন সরকারের প্রচেষ্টাও আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
চীন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে’– এ প্রত্যাশা রেখে ইনু বলেন, “বাংলাদেশেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা সমস্যা বিরাজমান। বাংলাদেশের ভালো বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে চীন সরকার এই সমস্যার সমাধানে তাদের সক্ষমতা কাজে লাগাবে বলে আশা করছি। আজকের এই অনুষ্ঠানের অন্যান্য বক্তার মতই আমি আজ জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, দারিদ্র্য বিমোচনে চীনের সংশ্লিষ্টতা চাচ্ছি।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, “এক চীন নীতি, চীনের সব ধরনের আন্তর্জাতিক নীতি এাগুলো আমরা সমর্থন করি, সে কথা আগের বক্তারা বলেছেন। সংস্কৃতি, শিক্ষা, বৃত্তি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি খাতে সহযোগিতার কথা আলোচিত হয়েছে।
“তবে আমি এই বৈঠক থেকে চারটি বিষয়ে প্রশ্ন রাখতে চাই। চীনা কর্তৃপক্ষ এখানে সরাসরি উত্তর দিতে না চাইলে নাও দিতে পারেন। তা হচ্ছে- কৌশলগত সহযোগিতা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বার্মা অ্যাক্ট এবং তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আপনাদের বক্তব্য শুনতে চাই।”
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান লিউ জিয়ানচাও বলেন, “সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর রয়েছে। সেখানে সবগুলো বিষয় আলোচনা করা হবে বলে আমি আশা রাখি। আমি চীনে গিয়েও বিষয়গুলো নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করব, যাতে আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ ও সুযোগগুলো খুঁজে বের করতে পারি।
“আর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, যোগাযোগ, গণপরিবেহন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে আরও বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু এটার সমাধান করা যে কত কঠিন সেটা আমি জানি।”
কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতা বলেন, “স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিষয়ে একজন অধ্যাপক বেশ সুন্দর প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। দারিদ্র্য বিমোচন, বিশ্বশান্তি, একচীন নীতি নিয়ে আপনারা সবাই কথা বলেছেন। এটাই শেষ বৈঠক নয়। আগামী সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগের একটি জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি দল চীন সফর করবে। সেখানে এসব নিয়ে আরও ব্যাপক আলোচনা হবে।”
অন্যদের মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের মহাসচিব দীলিপ বড়ুয়া, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।