“আমরা যারা ভুক্তভোগী, তারাই মামলার পরিস্থিতি জানি না, দেশের মানুষ কীভাবে জানবে?" বলেন সাকিব রহমান।
Published : 28 Nov 2024, 05:51 PM
পনের বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহের সময় ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ‘সঠিক বিচার' চাইতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নিহতের স্বজনরা।
হত্যাকাণ্ডের ‘প্রকৃত ঘটনা’ উন্মোচনসহ ‘পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রকারীদের' বিচার নিশ্চিতে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্রোহে নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহীর ছেলে আইনজীবী সাকিব রহমান।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার মহাখালী রাওয়া হলে ‘পিলখানায় ৫৭ অফিসারসহ ৭৪ জনের হত্যার বিচার এবং শহীদ সেনা দিবসের দাবিতে' আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা।
গত প্রায় ১৬ বছর ধরে চলা বিডিআর বিদ্রোহের মামলাটি আপিল বিভাগে থাকলেও সর্বশেষ পরিস্থিতি স্বজনদের জানা নেই দাবি করে সাকিব রহমান বলেন, “মামলা চলাকালীন এই দীর্ঘ সময়টাতে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। আমরা যারা ভুক্তভোগী, তারাই মামলার পরিস্থিতি জানি না, দেশের মানুষ কীভাবে জানবে?"
‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী বিগত সরকারের সময় ক্ষমতায় ছিল' মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের প্ল্যান অব অ্যাকশন হচ্ছে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কমপ্লেইন ফাইল করব।
“বর্তমান সরকারের এতোদিনেও আমাদের জন্য ৫ মিনিট সময় হয়নি, এখন যারা কমপ্লেইন ফাইল করব, সেসব শহীদ পরিবারকে সরকার নিরাপত্তা দিবে আশা করছি। কারণ আমরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব, তারা গত সরকারের ক্ষমতায় ছিল"
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে আছে ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।
হাই কোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাই কোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
ক্ষমতার পালাবদলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি উঠছে। এর মধ্যে অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা জানালেন নিহতের স্বজনরা।
নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহীর ছেলে আইনজীবী সাকিব রহমান বলেন, “শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করব। আন্তর্জাতিক আইনের ডকট্রিন অব কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকেও বিচারের মুখোমুখি আনা সম্ভব। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে তিনিও দায় এড়াতে পারেন না। তার বিরুদ্ধেও আমরা অভিযোগ করব।
“এছাড়া তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা, বিশেষ করে ডিজিএফআই কর্মকর্তা যারা ছিলেন। তখনকার সময় কিছু সাংবাদিক যারা ভুল ন্যারেটিভ সৃষ্টি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা অভিযোগ আনব।"
গত ৪ নভেম্বর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠান শেষে পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্ত ‘অবশ্যই হবে' বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকীন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, “বিগত ফ্যাসিবাদ সরকার আওয়ামী লীগ চাইবে না- গুম-খুনের বিচার হোক। যেহেতু এখন বাধা নেই, তাই বিডিআর সদস্য হত্যার তদন্ত দ্রুত শেষ করে জড়িতদের আইনের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হোক।"
পিলখানা হত্যার দিনকে শহীদ দিবস ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “জড়িতদের সাজা দিলে দেশের সকল মানুষ আমাদের পাশে দাঁড়াবে। হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ায় চাকরি থেকে যাদের বের করে দওয়া হয়েছে, তাদের সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থা করতে হবে।"
নিহতদের স্বজনদের তরফে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন নিহত কর্নেল মজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌসী।
তিনি বলেন, “গেজেটের মাধ্যমে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।"
আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারির আগেই এই দিবস ঘোষণা করে সেদিন দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার দাবি জানান তিনি।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে নতুন করে তদন্তের দাবি জানিয়ে নাহরীন ফেরদৌসী বলেন, “প্রস্তাবিত ইনকোয়ারি কমিশনের অগ্রগতি আমাদের জানানো হোক। ইতোপূর্বের সকল তদন্তের প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করার হোক।"
নিহত ৫৭ কর্মকর্তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি, পিলখানা ট্র্যাজেডিকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং দ্রুত বিচার শেষ করে নির্দোষদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপনা করেন নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফুর রহমান খানের মেয়ে ফাবলিহা বুশরা। এসময় বক্তব্য দেন শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী রবি রহমানের স্ত্রী ফৌজিয়া রশিদ ও তার ভাই কাজী ওলি রহমান, নিহত কর্নেল এরশাদের ভাই মামুন, নিহত মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান, নিহত কর্নেল কুদরত এলাহির স্ত্রী লবী রহমান।