‘যদি হাতে বাইজ্জা যায়, দুদিন চইলা তো খাইতে পারুম’

আগুনে দিশেহারা; তবুও পুড়ে যাওয়া সাততলা বস্তিতে শুরু হয়েছে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ঘিরে টিকে থাকার সংগ্রাম; কেউ কেউ হাতড়ে ফিরছেন শেষ সঞ্চয়টুকু।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2023, 04:53 PM
Updated : 27 March 2023, 04:53 PM

দূর থেকে আসা সামান্য আলো আর আধো অন্ধকারে পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসস্তুপে হাত চালিয়ে কিছু খুঁজছেন বয়োজ্যেষ্ঠ এক নারী, সঙ্গী তার ঘরের ভাড়াটে।

কী হারিয়েছে জানতে চাইলে ভবের মা নামের আড়ালে হারিয়া যাওয়া ছায়া রানী বললেন, “সবই তো হারাইলাম। কিছুই নাই। ঘর নাই, পরনেরডা ছাড়া একটা কাপড়ও নাই। হাতের-কানের দুইটা সোনার জিনিস আছিল তাও গেছে গা। ওইগুলাই খুঁজতাছি। যদি হাতে বাইজ্জা যায়, দুইদিন চইলা-ফিইর‌্যা তো খাইতে পারুম।”

সোমবার সকালে ঢাকার মহাখালীর সাততলা বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যাওয়া শতাধিক ঘরের মধ্যে ছায়া রানীর গেছে চারটি। সকালের আগুনে পুড়ে যাওয়া সেসব ঘরের একটিতে সন্ধ্যায় জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকু হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি।

সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে দেখা গেল শুধু ছায়া রানী নন, ঘর পুড়েছে যাদের তারা সবাই ব্যস্ত সেই পোড়া ঘরকেই ঘিরেই। রাত তো কাটাতে হবে, টিকে থাকার এ সংগ্রামে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না।

মহাখালীর সাততলা এ বস্তিতে আগুন লাগে সকাল পৌনে সাতটার দিকে। খবর পাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর ৯টা ৩৮ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই বস্তির শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। তবে হতাহতের কোনো খবর আসেনি।

‘এহন ঘর তুলমু কী দিয়া, খামু কী?’

বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ছায়া রানী। ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর ‘ভবের মা’ নামের আড়ালে সেই নামের পরিচয় কবেই ঘুচে গেছে। চোখে বলতে গেলে কিছুই দেখেন না। এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী বাজারের আগুনে নাজেহাল ছায়ারানীর সংসার চলছিল বস্তির দুটো ঘর ভাড়া দিয়ে আর ছেলের সামান্য আয়ে। সকালের আগুনে তার চারটি ঘরও পুড়ে গেলে আরও অন্ধকার যেন নেমে এসেছে সত্তোরর্ধ্ব এ বৃদ্ধার চোখে।

বিলাপ করে ছায়া রানী বলছিলেন, এখানে টিন, কাঠ, বাঁশ দিয়ে তৈরি তার দোতলা বাড়িতে চারটি ঘর ছিল। একটিতে তিনি আরেকটিতে তার ছেলে থাকত। বাকি দুটো ঘর ভাড়া দেওয়া।

একটি ঘরের ভাড়াটে আবুল কালাম রিকশা চালান, তার স্ত্রী বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। তিন ছেলে-মেয়েসহ এক ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। মাসে ভাড়া আড়াই হাজার টাকা।

কালামই ছায়া রানীর সঙ্গে ঘরের পোড়া জিনিসের মধ্যে এটা সেটা হাতড়াতে সহায়তা করছিলেন।

পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র আর কালো ধ্বংসস্তুপ থেকে একটা একটা করে জিনিস বের করছিলেন তিনি আর বলছিলেন, “দেহ কাকি তোমার শিল-পাটা ফাইট্টা কী হইছে, দেহ এইটা তোমার ভাত রান্দার হাড়ি।”

তিনি একটা করে পুড়ে যাওয়া, গলে মণ্ড হয়ে যাওয়া জিনিস বের করেন আর বৃদ্ধা ছায়া রানী দুই হাত ওপরে তুলে বিলাপ করতে থাকেন। বলতে থাকেন, “আমার সবই গেল গো। আমি এহন ঘর তুলমু কী দিয়া, খামু কী! পোলায় কী আমারে দেখব।”

মধ্যবয়সী এ রিকশাচালক বলেন, সকালে হঠাৎ কিছু একটা ফোটার শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে জাগতে না জাগতেই তার পিঠে আগুনের ফুলকি পড়ে। এরপর আর দরজা দিয়ে বের হতে পারেননি, টিনের বেড়া ভেঙে বের হয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী। ছেলে-মেয়েরা আগেই বের হয়েছে। তার তিন ছেলে-মেয়েই মাদ্রাসায় পড়ে।

তিনি বলছিলেন, “এহন পোলাপাইন নিয়া চলা এমনিতেই কষ্ট। যে জিনিসপত্রের দাম। এর মইদ্দ্যে লাগল আগুন। একটা সুতাও বাইর করতে পারি নাই। এহন এই বাড়িওয়ালির লগে টোকাইতাছি, যদি কিছু হাতে বাজে।”

কালাম বলেন, “গেরামে টিকবার না পাইরা এই ঢাকা শহরও আইছি। এই বস্তি ঘরে এতগুলা বছর ধইরা রইছি। সংসার বাড়ছে, ঘরে কিছু জিনিসপত্র হইছে। পোলাপাইনের বই-খাতা, কাপড় চোপড় কত কিছু আছিল। সবই গ্যাছে গা। এহন রিকশা বাইয়া পেটই চালাইতে পারি না। জিনিসপত্র ক্যামতে কিনমু। অন্তত কয়ডা কাপড় তো কিনন লাগব।”

বস্তিতে নেতা হিসেবে পরিচিত আবু ইউসুফ মৃধা বলছেন, তাদের হিসেবে মোট ২৬টি বাড়ি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে একেকটি বাড়িতে চার থেকে ১০টি পর্যন্ত ঘর ছিল। প্রতি ঘরে একটি করে পরিবার থাকে। সব মিলিয়ে শতাধিক পরিবার ক্ষতির মুখে পড়েছে।

পাশের বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) এক কর্মচারী নেতার উদ্যোগে স্থানীয় তরুণরা খিচুড়ি রেঁধে ইফতারির পর বাড়ি বাড়ি দিয়ে এসেছে। সেহরির জন্যও একইভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ব্র্যাকের তরফ থেকে এক কার্টন করে সাহায্য সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে সন্ধ্যা অবধি।

অপরদিকে সন্ধ্যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের নির্দেশও দিয়েছেন বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

বস্তির একটি ঘরে মেস করে থাকতেন মনসুর আলী, মজিবর রহমানসহ চারজন নির্মাণ শ্রমিক। সোমবার ভোরে উঠেই তারা মহাখালী টিবি গেইট এলাকায় একটি ছাদ ঢালাইয়ে জোগালির কাজ করতে চলে যান।

আগুনের খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখেন ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মন খারাপ করে কাজে ফিরে যান। পরে সন্ধ্যায় এসে দেখেন তাদের ঘরের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জিনিসপত্র কিছুই পোড়েনি। শুধু তোশক আর কাপড়গুলো পানিতে ভিজে গেছে।

মনসুর আর মজিবরকে দেখা গেল অন্ধকারে নিজেদের ঘর পরিষ্কার করতে; রাতটা তো কাটাতে হবে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

তাদের থেকে একটু দূরে ঘর খুঁজতে দেখা গেল বস্তির আরেক বাসিন্দা পঙ্গুত্বের শিকার তরুণ আল-আমিনকে। হুইল চেয়ারটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাদের। তার মা গেছেন খিচুড়ির সন্ধানে।

আগুন লাগার সময়কার কথা তুলে ধরে আল আমিন বলেন, তার মা ও প্রতিবেশী একজন কোলে করে তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়। তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মা তেমন কিছুই ঘর থেকে বের করতে পারেননি।

তার মা কাজ করেন আর তিনি ‘সাহায্য চেয়ে’ জীবিকা নির্বাহ করেন বলে জানান।

Also Read: মহাখালীর সাততলা বস্তি ও কাপ্তান বাজারে আগুন, পুড়েছে ঘর

Also Read: সাততলা বস্তিতে আগুন: ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবার পাচ্ছে ৫ হাজার টাকা