ভারতে বন্দি বাংলাদেশিদের কেউ গুমের শিকার কি না মিলিয়ে দেখা হচ্ছে, বলেন মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
Published : 04 Mar 2025, 05:07 PM
‘গুমের শিকার হয়ে’ ফিরে না আসা ৩৩০ জন ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা জানতে অনুসন্ধান চলছে বলে তুলে ধরেছেন গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
তবে তাদের ফিরে আসার আশা ক্ষীণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর গুলশানে গুম কমিশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গুম কমিশনের সভাপতি এই মন্তব্য করেন।
ভারতে বন্দি থাকা বাংলাদেশিদের যে তালিকা পাওয়া গেছে সেখানে গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি আছে কি না, মিলিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও তুলে ধরেন মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের কারাগারে বন্দি বাংলাদেশি নাগরিকদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল।
“ভারত এক হাজার ৬৭ জনের একটি তালিকা দিয়েছে, সেটি গুম সংক্রান্ত কমিশন মিলিয়ে দেখছে, সেই তালিকায় গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি আছে কিনা, তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এই তালিকা ভারত আরো দিবে।”
মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সীমান্তবর্তী জেলার পুলিশ সুপার ও বিজিবির সেক্টর কমান্ডারদের কাছ থেকে অগাস্টের পর ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা ১৪০ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে কোনো গুমের শিকার ব্যক্তির নাম এখনও পাওয়া যায়নি।
“ধামরাই থেকে গুম হওয়া মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে গত ২২ ডিসেম্বর চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন অনুসন্ধান করছে।”
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে হাই কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে ‘গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি’ গঠন করেছে সরকার।
গত ২৭ অগাস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনকালে ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়ার পর লাশ উদ্ধার বা নিখোঁজের ঘটনাগুলো আলোচনায় ছিল।
এসময় হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘদিন আটকে রাখার ঘটনাগুলোও উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন বন্দিশিবির তৈরি করে নির্যাতনের অভিযোগও আসে বিভিন্ন প্রতিবেদনে।
গুম কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কমিশনে ১ হাজার ৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে ১ হাজারটি অভিযোগ ও তার সাথে সংযুক্ত কাগজপত্রের যাচাই-বাছাই প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কমিশনে ২৮০ জন অভিযোগকারীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে।
“এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪৫ জন কর্মকর্তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। গুমের শিকার হয়ে ফিরে না আসা ৩৩০ জন ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা বা ভাগ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান চলমান আছে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় তাদের ফিরে আসার আশা ক্ষীণ।”
তিনি বলেন, “সরকারের সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার নির্দেশে গুমের ঘটনা ঘটেছে। এটা আমরা আগেও বলেছি।”
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক, ডিজিএফআই এর মহাপরিচালক ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে বলে তুলে ধরেন তিনি।
পুলিশ লাইনসেও গোপন বন্দিশালা পাওয়ার তথ্য জানিয়েছে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন।
বগুড়া পুলিশ লাইনে এ বন্দিশালা পাওয়া গেছে দাবি করে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, “পুলিশ লাইনের ভেতরে কারাগারের মতো গোপন বন্দিশালা তৈরি করে রাখা হয়েছিল। যেটি একেবারেই অ্যাবসার্ড একটা ব্যাপার। সেটি আমরা বগুড়ায় পেয়েছি। আমাদের ধারণা অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আরও পাবো।”
এসব বন্দিশালা গত ১৫ বছরে করা হয়েছে কি না, এক সাংবাদিদের এ প্রশ্নে নূর খান বলেন, “এগুলো গত ১৫ বছরের মধ্যেই বানানো হয়েছে। সম্ভবত গত ১০-১২ বছরের মত। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে বন্দিদের এনে রাখা হতো, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। এখান থেকেও অনেকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।”
গুমের অপরাধের দায় ব্যক্তির, এ দায় কোনো বাহিনীর নয় মন্তব্য করে কমিশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যে সকল সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুম করার অভিযোগ আছে, তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অনুসন্ধান করছে কমিশন। কেউ কেউ আশংকা করছেন যে গুমের সাথে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির জন্য পুরো বাহিনী আতংকগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যে সকল সদস্যরা গুমের সাথে জড়িত, তা তাদের ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায়। কারণ অপরাধীরা অনেক সময় আইনের হাত থেকে বাঁচতে তার ধর্ম, কমিউনিটি, সামাজিক গ্রুপ, ইত্যাদির আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করে।
“কিন্তু বিচার কখনো ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে হয় না, তা হয় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। কারণ ফৌজদারি অপরাধ একটি ব্যক্তিগত দায়, এতে কমিউনিটিকে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।”
গুমের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায় পুরো বাহিনীর উপর বর্তায় না মন্তব করে গুম কমিশনের প্রধান বলেন, “গুমের সঙ্গে জড়িত নির্দেশদাতাদের দায় আছে। তাদের সংখ্যাও অনেক। প্রত্যেক বাহিনীতে নির্দেশদাতা ও গোপন বন্দিশালা ছিল।”
গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন করল সরকার
গুম তদন্ত কমিশন: অভিযোগের বেশিরভাগই র্যাবের বিরুদ্ধে
গুম তদন্ত কমিশনের মেয়াদ বাড়ল মার্চ পর্যন্ত
'গুম-সংক্রান্ত কমিশনে' অভিযোগের সময় বাড়ল দ্বিতীয় দফায়
নারীদের সঙ্গে শিশু সন্তানরাও 'গুমের শিকার' হয়: কমিশনের প্রতিবেদন