সাড়ে পাঁচ পাতার প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নানান দূর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
Published : 20 Jan 2025, 11:17 PM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে জোরপূর্বক গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে সংখ্যায় কম হলও নারী ও শিশু থাকার তথ্য উঠে এসেছে গুম বিষয়ে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে।
এক নারী ভুক্তভোগীর ঘটনা বর্ণনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, নারী গুমের ঘটনায় তাদের সঙ্গে ‘সন্তানদেরও গুম’ করা হয়েছে।
“তিনি গর্ভবতী অবস্থায় এক মাস বন্দি ছিলেন এবং তার তিন বছর ও আঠারো মাস বয়সী শিশু সন্তানদের তার সঙ্গে আটক রাখা হয়। তিনি জানান, গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও তাকে এক পুরুষ কর্মকর্তাকে দিয়ে মারধর করা হয়।”
রোববার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তদন্তের অগ্রগতি তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রধান উপদেষ্টা শিগগির ‘আয়না ঘর’ পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বলেছেন।
সেই প্রতিবেদনেরই অংশবিশেষ সোমবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর প্রকাশ করেছে।
সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নানান দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে পরিকল্পিতভাবে ‘গুমের’ শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা ও উদ্ধারের প্রচেষ্টায় বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে।
কমিশন ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। পরের দিন এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও করা হয় ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে।
রোববারে দাখিল করা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে জোরপূর্বক গুমের শিকার ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন তাদের মৌলিক অধিকার থেকেও।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘গুমের’ অনেক অভিযোগই গ্রহণ বা তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ‘উপরে থেকে আদেশ’ পাওয়ার অজুহাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে তারা নিস্ক্রিয় ছিল বলে তুলে ধরা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে।
নারী ও শিশু ভুক্তভোগীদের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরুষ ভুক্তভোগীর তুলনায় নারী ভুক্তভোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম পাওয়া গেছে। এর একটি কারণ হলো জবরদস্তি গুমের শিকার পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
“অনেক নারী ভুক্তভোগী সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে সামনের সারিতে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত। বেশ কয়েকজন সাহসী নারী তাদের অভিজ্ঞতা গুম কমিশনের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন, প্রতিবেদনে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের অপহরণ, বন্দি অবস্থায় নির্যাতন এবং পরে বিচার ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশের বর্ণনা অনেকাংশে পুরুষ ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, নারীদের নিশানা করা হয়েছে তাদের পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে, যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে অভিযুক্ত ছিলেন।
মায়েদের সঙ্গে শিশুদের জবরদস্তি গুম করার তথ্য পাওয়ার কথা বলেছে কমিশন।
এতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে শুরু করে ঢাকার সিটিটিসি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “এক পুরুষ ভুক্তভোগী জানান কীভাবে তার স্ত্রী ও নবজাতক শিশুকে একটি থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে শিশুটিকে মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত করা হয়, যা তার প্রতি মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের একটি পদ্ধতি ছিল।”
এসব ঘটনায় মায়েদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হত তুলে ধরে গুম কমিশন বলেছে, তাদের শিশুদের বন্দিত্বকালীন সময়ে সঙ্গে রাখবে, নাকি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পাঠাবে এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকতেন তারা।
“তবে, রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানের অযত্ন ও নির্যাতনের ব্যাপক বদনামের কারণে, মায়েরা প্রায়শই তাদের সন্তানদের সঙ্গে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তাদের পছন্দ থাকে শিশুদের পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে রাখা। কিন্তু জবরদস্তি গুমের ফলে পরিবারগুলোকে জানানো হয় না যে ভুক্তভোগীরা বন্দি আছেন।”
এক শিশুর ঘটনা প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়েছে, মাত্র ছয় বছর বয়সে তাকে তার মায়ের সঙ্গে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম সিটিটিসি-তে ‘আটক রাখা হয়েছিল’।
আরেকটি ঘটনায়, “এক মা ও তার ছোট মেয়েকে তুলে নিয়ে র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে রাতভর আটকে রাখা হয়। পরের দিন মেয়েটিকে একটি গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়।”
প্রতিবেদনে পরিবারের ভাষ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, এক ইমাম শিশুটিকে উদ্ধার করে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেন। ওই মেয়েটি এখন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, তাকে নিয়ে গুম কমিশন র্যাব স্থাপনাগুলোতে নিয়ে গেলে তিনি সেই কক্ষ চিহ্নিত করেন, যেখানে তাকে সেই রাতে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, তার মা আর কখনো ‘ফিরে আসেননি’।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের উপর প্রভাবের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বহুমুখী প্রভাবের মধ্যে তীব্র মানসিক আঘাত, আইনি জটিলতা ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ থাকার কথা তুলে ধরে বলা হয়, “পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি, হুমকি, হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শনের শিকার হন।
“প্রিয়জনদের সন্ধানে সহায়তা করার আশায় তারা কর্তৃপক্ষকে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করলেও, পরিবারগুলো প্রায়ই অবিরাম চাপ এবং ভয়ের মুখোমুখি হয়।”
এক ভুক্তভোগীর কিশোরী মেয়ের ঘটনা তুলে ধরা বলা হয়, স্কুলের পোশাকে সে কমিশনের দপ্তরে আসে। মেয়েটির বাবা প্রায় এক দশক আগে গুমের শিকার হন, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। বাবার কোনো স্মৃতি তার নেই, তবু এ ঘটনা তার মানসিক আঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে। তার মা এখনও তার বাবার জামা ইস্ত্রি করে সংরক্ষণ করে রাখেন, তার ফিরে আসার অপেক্ষায়।
সে মা কাঁদতে কাঁদতে কমিশনকে বলেছেন. ৫ অগাস্টের পরিবর্তনের পরেও তার পরিবার নিরাপদ থাকবে কি না তা নিয়ে তিনি শঙ্কিত।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর আর্থিক সংকট ও দুর্দশার কথাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। ফলে, তাদের পরিবারগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করছে।
আদালতের আদেশ ছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার ক্ষেত্রে জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে অন্তত সাত বছর সময় লাগে। এ সময়ে, ভুক্তভোগীর সম্পদ ও সম্পত্তি পরিবারের জন্য অপ্রাপ্য থাকে। এমনকি আদালতের আদেশ পাওয়ার পরও, প্রিয়জনকে প্রমাণ ছাড়াই মৃত ঘোষণা করার মানসিক বোঝা পরিবারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
কমিশন মনে করছে, গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই সমাজে কলঙ্কিত হন। তাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, বাসা ভাড়া পেতে সমস্যায় পড়েন।
কমিশনের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, “আওয়ামী লীগ জবরদস্তি গুমের শিকার পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়েছে, যার মধ্যে সাইবারস্পেসে চরিত্র হননও অন্তর্ভুক্ত। তাদের জীবনে গুরুতর প্রভাব পড়েছে।”
পরিবারগুলোর মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি অবিলম্বে সমাধানের প্রয়োজন বলেও সেখানে অভিমত দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুমের ঘটনাকে ভিত্তিহীন দাবি করে উড়িয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা এমনও বলেছে ভুক্তভোগীরা দেনাদারদের এড়াতে বা ব্যক্তিগত কারণে লুকিয়ে ছিল।
“ভুক্তভোগীদের যারা ফিরে এসেছেন, তাদের প্রায়ই নতুন অন্যায়ের শিকার হতে হয়েছে। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আদালতে হাজির করার ঘটনা আছে।”
বিচারিক ব্যবস্থাও ভুক্তভোগীদের জন্য কার্যকর কোনো প্রতিকার দিতে পারেনি তুলে ধরে কমিশন বলেছে, বেআইনিভাবে আটক রাখা বা গুম করা ব্যক্তিদের উদ্ধারে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হলেও সেগুলো প্রায়ই দাখিলের প্রাথমিক পর্যায়েই থেমে গেছে। ফলে ভুক্তভোগীরা কার্যকর আইনি প্রতিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।
গুমের কয়েকটি মামলায় আদালতের রায় ন্যায়বিচারের চেয়ে প্রচলিত অবস্থাকে বৈধতা দেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিল তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
বলা হয়েছে, নিম্ন আদালত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ব্যাপকভাবে ‘নির্ভরশীল’ ছিল, যাদের অনেকেই এই অপরাধের সঙ্গে ‘সরাসরি জড়িত ছিলেন’।
শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দায়মুক্তির একটি সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছিল উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, তারা তাদের অপরাধের জন্য কখনো জবাবদিহি করতে হবে বলে আশা করেননি। বরং, তারা এসব কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবেও বিবেচনা করেননি।”
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ক্ষমাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গত ২৭ অগাস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এ কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের দিন পর্যন্ত সময়ের ঘটনা কমিশনের বিবেচনায় আনা যাবে।
ইতোমধ্যে ‘গুমের’ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মেখ হাসিনাসহ তার সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ সরকারির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দায়মুক্তির সংস্কৃতি বজায় রাখতেই ৫ অগাস্টের পর ডিজিএফআই সদর দপ্তরের যৌথ অনুসন্ধান কেন্দ্র (জেআইসি)-এর কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন, যেমন বন্দিদের খোদাই করা তথ্য মুছে দিতে দেয়ালে রং করার মত ঘটনা ঘটেছে বলে গুম কমিশন মনে করছে।
প্রমাণ বিকৃতি এবং অসহযোগিতার এই ধারা শুধু ডিজিএফআই-এ সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও গত ১৫ বছরের অপরাধের প্রমাণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে লোপাট করা হয়েছে বলে কমিশন মনে করে।
শিগগির 'আয়নাঘর' পরিদর্শনে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা