যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের আলোচনা সভায় দুই দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
Published : 27 Sep 2024, 01:56 AM
জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া দুর্নীতিবিরোধী শাসন টিকবে না মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই উদ্দেশে তার সরকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশেও সংস্কারের কাজ শুরু করেছে।
তিনি বলেছেন, “দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আমাদের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না।”
বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের দ্য ওয়েস্টিন নিউ ইয়র্ক গ্রান্ড সেন্ট্রালে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের এক আলোচনা সভায় দুই দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে এখন নিউ ইয়র্ক অবস্থান করছেন। সেখানে ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও দেশের প্রধান এবং প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনের আয়োজন করা আলোচনা সভায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ হিসেবে সম্বোধন করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “প্রায় দুই মাস হল বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পর ইতিহাসে এই প্রথম এক ব্যতিক্রমী পরিবর্তন দেখছে। সেই পরিপ্রেক্ষিত ও অবস্থা আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে।
“আমাদের দেশের তরুণরা আমার ওপর বিশ্বাস করে অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা সংস্কারের ভার দিয়েছে আমাকে।”
তিনি বলেন, জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে এমন একটি পরিবেশ তৈরির কাজ শুরু করেছে, যেখানে ব্যবসার প্রসার হবে এবং উদ্যোক্তা তৈরি হবে।
ব্যবসার জন্য স্থিতিশীল ও ভবিষ্যতের পূর্বাভাস বোঝা যায় এমন একটি দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ দরকার বলে মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল করা জরুরি, যা আমরা শুরু করেছি।”
অর্থনীতির অগ্রগতি এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করে দেওয়ার কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “দুর্নীতি ও অনিয়ম আমাদের রাজস্ব ও মুদ্রা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের নীতি-নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন।”
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে আগের সরকারের পতনের পর তার নেতৃত্ব নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে বলতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “প্রায় মাসখানের মধ্যে আমরা রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, টাকার স্থিতিশীলতা এসেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পেরেছি।”
দুর্নীতিমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এরই মধ্যে তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমরা ঘাটতি মেটাতে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি, যাতে মূল্যস্ফীতি না বাড়ে।”
আগের সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক প্রভাবে নেওয়া প্রকল্প বাদ দিচ্ছি আমরা। বাস্তবায়নের অগ্রগতির ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো থেকে কীভাবে অর্থ সাশ্রয় করা যায়, সেটি পর্যালোচনা করে দেখছি; ক্ষেত্রবিশেষে ফলপ্রসূ হবে না- এমন প্রতীয়মাণ হলে সেই প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
এ সময় তিনি রাজস্ব খাতের দুর্বলতাগুলো খতিয়ে দেখে তা কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে তার সরকারের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। এই ইস্যুতে গত দুই দিনে বিশ্ব ব্যাংক, ইউএসএআইডি, এমন কি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে তারা আর্থিক ও অ-আর্থিকভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের লাভের টাকা দিতে অসুবিধার মুখে পড়েছে, সেটি তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হওয়ায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাতে আর না কমে, সে জন্য আমরা সরকারের মধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি।”
এরই মধ্যে মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। দৃঢ় নেতৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে উজ্জীবিত করেছে। তারা স্বাধীন মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও ব্যাংকিং খাতের অনিময় দূর করতে কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তরুণদের কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে মোট শ্রমশক্তির যে ৩৭ শতাংশ তরুণ, তাদের কাজে লাগতে হবে।
শ্রম খাতের সংস্কারে আইএলও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ শরু করার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তর, জলবায়ু অর্থায়নের মাধ্যমে সম্পদ ত্বরাণ্বিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য সবুজ প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার কাজ শুরু করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও মজুদ করার লক্ষ্য রয়েছে জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ইন্দো প্যাসিফিক পলিসির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তার বৃহত্তর সাপ্লাইন-চেনের অংশ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপযুক্ত লক্ষ্যস্থল হতে পারে।
বক্তব্যের শেষে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আমরা আমাদের ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যা আমরা এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছি।”